ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ হত্যা মামলায় চার জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
আজ বুধবার(১৩ এপ্রিল) ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন— মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার আলম ওরফে ভাগিনা শহিদ, সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন, নূর মোহাম্মদ ওরফে সাবু।
চারজনের মধ্যে জেএমবির শূরা সদস্য মিজানুর ও আনোয়ারুল কারাগারে আছেন। সালেহীন ও নূর মোহাম্মদ পলাতক।
রায়ে বিচারক বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের এ জঘন্য অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক দুই আসামি যেদিন গ্রেপ্তার হবেন বা আত্মসমর্পণ করবেন সেদিন থেকে তাদের রায় কার্যকর হবে।
মামলার বিবরণে জানা গেছে, একুশে বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনে সন্ত্রাসী হামলার শিকার হন হুমায়ুন আজাদ। তাকে চাপাতি ও কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। ঘটনার পরদিন হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন এবং তাদের এ জঘন্য অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক দুই আসামি যেদিন গ্রেপ্তার হবেন বা আত্মসমর্পণ করবেন সেদিন থেকে তাদের রায় কার্যকর হবে।
এ ঘটনায় ২২ দিন রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) এবং ৪৮ দিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন হুমায়ুন আজাদ। পরে জার্মানির মিউনিখে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই বছরের ১২ আগস্ট মারা যান তিনি। তার মৃত্যুর পর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। এ ছাড়া একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনেও অপর একটি মামলা হয়।
২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল ওই মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির পরিদর্শক লুৎফর রহমান পাঁচ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন। একই বছরের ১০ সেপ্টেম্বর ওই পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
এর আগে ২০০৭ সালের ১১ নভেম্বর মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পাঁচজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে আবুল আব্বাস ভূঁইয়া ও গোলাম মোস্তফা নামের দুই আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দেওয়া হয়।
বহুমাত্রিক লেখক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই।
১৮ বছর আগে এই দুই জঙ্গি নেতার নির্দেশে আতাউর রহমান সানির নেতৃত্বে মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ, আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগনে শহীদ, নূর মোহাম্মদ ওরফে শামীম, হাফিজ মাহমুদসহ অন্যরা হুমায়ুন আজাদকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করেন।
মামলার নথি, অভিযোগপত্র ও দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে এই তথ্য জানা গেছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া দুই আসামি হলেন মিজানুর ও আনোয়ারুল।
দুই আসামির স্বীকারোক্তির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে অমর একুশে বইমেলায় হুমায়ুন আজাদের উপন্যাস ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ প্রকাশিত হয়। বই আকারে প্রকাশের আগে উপন্যাসটি একটি জাতীয় দৈনিকের ঈদসংখ্যায় ছাপা হয়। তখন জঙ্গিরা ঈদসংখ্যাটি সংগ্রহ করে শায়খ আবদুর রহমানের নজরে আনেন। তিনি উপন্যাসটি পড়ে হুমায়ুন আজাদকে হত্যার নির্দেশ দেন।
মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, হুমায়ুন আজাদকে হত্যা করতে জেএমবির সামরিক কমান্ডার সানিকে নির্দেশ দেন শায়খ আবদুর রহমান।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদের ওপর হামলা হয়। তাকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরদিন তার ভাই মঞ্জুর কবির রাজধানীর রমনা থানায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। বিদেশে উন্নত চিকিৎসা শেষে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর একই বছরের ১২ আগস্ট জার্মানিতে মারা যান হুমায়ুন আজাদ। এরপর মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর করা হয়।
মামলাটি তিন বছর তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ১৪ জানুয়ারি পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্ত কর্মকর্তা। ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
মামলায় কারাগারে বন্দী রয়েছেন জেএমবির শুরা সদস্য মিজানুর ও আনোয়ারুল। পলাতক আছেন সালেহীন ওরফে সালাহউদ্দিন ও নূর মোহাম্মদ। মারা গেছেন হাফিজ মাহমুদ। অন্য একটি মামলায় ২০০৭ সালে আবদুর রহমান, বাংলা ভাই ও সানির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বাবা হত্যার বিচার চেয়ে আদালতে সাক্ষ্য দেন হুমায়ুন আজাদের মেয়ে মৌলি আজাদ। তিনি আদালতকে বলেন, ‘আমার পিতা একজন প্রথাবিরোধী লেখক। তিনি অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো দলাদলিতে ছিলেন না। সমাজের বাস্তবতা নিয়ে তিনি নিজে যা বুঝতেন, তা–ই প্রকাশ করতেন। এ দেশের ধর্মীয় উগ্রবাদী-মৌলবাদীদের দৈনন্দিন ও পূর্বাপর কীর্তিকলাপ নিয়ে তিনি স্পষ্টভাবে লিখতেন, প্রচার ও প্রকাশনা করতেন।’
বাবার বিভিন্ন উপন্যাস ও প্রবন্ধ নিয়ে মৌলি আজাদ বলেন, ‘আগে তাঁর (হুমায়ুন আজাদ) সাড়াজাগানো গবেষণাগ্রন্থ “নারী” প্রকাশিত হলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে। পরে হাইকোর্ট নারী প্রকাশনার ওপর বেআইনি হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে তিনি আরও উপন্যাস-প্রবন্ধ লেখেন, যা মৌলবাদীরা না পড়ে বিরোধিতা করতেন।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩২৪
আপনার মতামত জানানঃ