অভাবের তাড়নায় পরিবারকে সুখে রাখতে স্বদেশ ও স্বজনদের ছেড়ে ভিনদেশে পাড়ি দেয়া প্রবাসী শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে অনেক নারী শ্রমিকও। যার একটি বড় অংশ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীর কাজে নিয়োজিত। প্রবাসে থাকা নারী গৃহকর্মী নির্যাতনের কথা আমরা প্রায় শুনে আসছি মিডিয়ার মাধ্যমে। কিছু কিছু ঘটনার বিবরণ হতবাক করে দেয় সবাইকে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে এক সময় বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নারী গৃহকর্মী পাঠানোর মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় দেশটির সরকার।
অন্যদিকে বিদেশে নারী গৃহকর্মী দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে বেশকিছু বিধিমালা থাকলেও কিছু অসাধু ট্রাভেল এজেন্সি সরকারের দেয়া নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে ভাড়াটে দালালদের মাধ্যমে নানা রকম মিথ্যে প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার নারীকে বিদেশে পাঠায়। এর মধ্যে সব থেকে বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে।
আর এই সৌদি আরবেই গৃহকর্মী নির্যাতনের খবর শোনা যায় অনেক বেশি। এমনকি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেক গৃহকর্মীকে পালিয়ে এসে রাস্তায় ঘুরতেও দেখা গেছে। মাঝে মধ্যে এমন কিছু ভয়ঙ্কর নির্যাতনের খবর আসে যা কল্পনাতীত।
তেমনি ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার এক গৃহকর্মীর নাম শিখা। রাজধানীর উত্তরখানের চানপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকে শিখার পরিবার। তার স্বামী হযরত আলী; সংসারে দুই ছেলে ও এক মেয়ে। ঘরে সচ্ছলতা আনতে গত সেপ্টেম্বরে রাজধানীর বনানীর একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে যান শিখা। সেখানে যাওয়ার পর তিন মাস সবকিছু ছিল ঠিকঠাক। পেয়েছেন বেতন ও খাবার। এর পর থেকে বন্ধ বেতন। খাবারও দেওয়া হয় না ঠিকমতো। বেতন-খাবার চাইলেই তার ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতনের খড়্গ।
তামান্না নামের এক নারীর সহায়তায় সৌদিতে যান শিখা। স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে তার সঙ্গে যোগাযোগও করেন হযরত আলী। তবে তামান্নার পক্ষ থেকে মেলেনি সাড়া। হযরত আলীর সঙ্গে গত রোববার সন্ধ্যার পর কথা হয় জাতীয় দৈনিক সমকালের।
তিনি বলেন, ‘স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হন্যে হয়ে ঘুরছি বিভিন্ন জায়গায়। কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। স্ত্রী দেশে ফেরার জন্য প্রতিদিন ফোন করে কান্নাকাটি করছে।’
হযরত আলীর ইমো নম্বর থেকে শিখা বেগমের সঙ্গে রোববার কথা হয়। তিনি জানান, ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি সৌদিতে যান। বিমানবন্দর থেকে সে দেশের একটি অফিসে নেওয়া হয় তাকে। এক দিন পরই তাকে আতর আলি নামের একজনের বাসায় কাজ দেওয়া হয়। কথা ছিল, মাসে দেওয়া হবে ২২ হাজার টাকা বেতন। পরে দেওয়া হয় ১৬ হাজার টাকা। পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলার জন্য ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়ার কথা থাকলেও দেয়নি। বেতন থেকে মাসে ইন্টারনেট খরচ চলে যায় তিন হাজার টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ঠিকমতো বেতন পেয়েছেন তিনি। এর পর থেকে বেতন বন্ধ। রমজানে সেহরিতে একটি রুটি এবং ইফতারের সময় দুটি রুটি পান তিনি। রমজানের আগে সকালে দুটি পাতলা রুটি, দুপুরে অল্প একটু ভাত দেওয়া হতো; যা খেয়ে ক্ষুধা মিটত না তার। বাড়ির মালিকের কাছে বেতন ও পেট ভরে খাবার দাবি করায় গত ২৯ মার্চ তাকে ওই বাসা থেকে প্রাইভেটকারে তিন ঘণ্টার পথ দূরত্বে একটি অফিসে নিয়ে যান আতর আলি। সেখানে একটি কক্ষে আটকে মেঝেতে ফেলে লোহার পাইপ দিয়ে শিখাকে পেটানো হয়।
‘স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হন্যে হয়ে ঘুরছি বিভিন্ন জায়গায়। কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। স্ত্রী দেশে ফেরার জন্য প্রতিদিন ফোন করে কান্নাকাটি করছে।’
তিনি জানান, তার হাঁটু, দুই হাতের আঙুল, হাতের কনুইসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে পাইপের আঘাতের কারণে কালচে দাগ হয়ে গেছে। প্রচণ্ড ব্যথায় ঠিকমতো হাঁটতে পারছেন না, হাত নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। এই শরীর নিয়েও কাজ করতে হচ্ছে তাকে।
শিখা বলেন, ‘আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ফুলে গেছে। কষ্ট হচ্ছে খুব। অনেকবার বাড়ির মালিককে বলেছি, ওষুধ কিনে দিতে। একটা ওষুধও দেয়নি। কত দিন পেট ভরে খাইনি।’ দেশে ফেরার আকুতি জানান এই নারী।
শিখা বেগম বলেন, ‘লোহার পাইপ দিয়ে পিটিয়ে পুরো শরীরে কালো বানিয়ে দিয়েছে। কাতরাচ্ছি ব্যথায়। ওষুধও দিচ্ছে না। পেট ভরে খেতে দেয় না চার মাস। আমি বাঁচতে চাই। এখানে থাকলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। দয়া করে এই দেশ থেকে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যান।’
শিখার স্বামী হযরত আলী বলেন, ‘সংসারে বড্ড অভাব। তাই স্ত্রীকে সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। একই এলাকার শাহ আলম নামের এক ব্যক্তি বনানীতে তামান্না নামের এক নারীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তামান্না একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে শিখাকে সৌদিতে পাঠান। যাওয়ার প্রথম তিন মাসে মোট ৩৪ হাজার টাকা পাঠিয়েছিল শিখা।’
তামান্নার সঙ্গে গতকাল সোমবার ফোনে কথা হয়। তিনি শিখাকে বিদেশে পাঠানোর কথা স্বীকার করলেও রিক্রুটিং এজেন্সিটির নাম মনে নেই বলে দাবি করেন। তামান্না বলেন, ‘আমি বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করি। কোন এজেন্সির মাধ্যমে শিখাকে পাঠিয়েছি, তা এখন মনে পড়ছে না।’ শিখাকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
অভাব-অনটন বেশি থাকা এবং আয়-উপার্জনের সুযোগ কম থাকায় প্রতিবছর বহু বাংলাদেশি বিদেশে পাড়ি জমান। সাম্প্রতিক সময়ে পুরুষের পাশাপাশি বিদেশগামী নারী কর্মীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। তারা যান মূলত মধ্যপ্রাচ্যে এবং গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে। কিন্তু সেখানে নারী কর্মীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসে কাজের জন্য যাওয়া নারী কর্মীদের ওপর করোনা মহামারির প্রভাব যাচাইয়ে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) পরিচালিত এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে যে, পরিবারের ভাগ্য বদলাতে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে কর্মস্থলে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন ৩৫ শতাংশ নারী কর্মী। মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার ৫২ শতাংশ আর যৌন নিপীড়নের শিকার ১১ শতাংশ নারী। নিয়োগকর্তা ও তার স্ত্রীর হাতে এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দেশে ফিরে তালাক, অসুস্থতা, সামাজিক কলঙ্কসহ নানা সমস্যার মধ্যে পড়েছেন ২২ ভাগ নারী।
যেসব নারী গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করার জন্য বিদেশে যান, তাদের বেশির ভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। অসচ্ছল বা স্বামী পরিত্যক্ত নারীরাই মূলত কাজ করার জন্য এসব দেশে যাচ্ছেন। যখন নারী শ্রমিকদের কথা আসে তখন তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও সামনে আসে।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এসব প্রবাসী নারীকর্মীর নিরাপত্তার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। নারীকর্মীদের বেশিরভাগই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দাসীর মতো ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন অনেক ঘটনার বিবরণ আমরা খবরের কাগজে দেখতে পেয়েছি। যে স্বপ্ন নিয়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমাচ্ছেন নারীরা, তা খুব কম সময়ের ব্যবধানেই বালির বাঁধের মতো ভেঙে যাচ্ছে। এ নারীদের অনেকেই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গৃহকর্মী নিয়োগের কথা বলে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে যৌনকর্মী হিসেবে। তারা সেখানে গিয়ে কী কাজ করছেন, কেমন আছেন, তার দেখভালও সরকার করে না। বিদেশে নারী কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে দালালদের প্রতারণা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।
অন্যদিকে, দেশে ফেরা এসব অভিবাসী নারী শ্রমিকের অনেককেই পড়তে হয় নতুন মানসিক চাপে। সমাজ এমনকি পরিবারের সদস্যদের কাছেও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হতে হয় তাদের। কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বামীরা তাদের তালাক পর্যন্ত দেন আর অবিবাহিত নারীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সৃষ্টি হয় শঙ্কা ও জটিলতা। ফলে সার্বিকভাবে এই বিষয়গুলো কতটা ভয়ানক তা সংশ্লিষ্টদের আমলে নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিশ্চিত জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়।
তারা বলেন, বলার অপেক্ষা রাখে না, এর আগেও এমন বিষয় উঠে এসেছে যে, চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীকর্মীর সংখ্যা কমছে। আমরা বলতে চাই, স্বচ্ছলতার আশায় বিদেশ গমন করে নির্যাতিত হয়ে ফিরে এলে তা কতটা ভয়ানক সেটা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য হওয়া দরকার, বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকের সুরক্ষা সংক্রান্ত সামগ্রিক বিষয় নিয়ে উদ্যোগী হওয়া।
আরও বলেন, সর্বোপরি, আমরা বলতে চাই, বাংলাদেশ জনসংখ্যাবহুল দেশ, ফলে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করার বিষয়টি জরুরি। এ ক্ষেত্রে, নারীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। একইসঙ্গে বিদেশে কর্মরত নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫৫
আপনার মতামত জানানঃ