ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতির পর পাকিস্তানের ২৩তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) নেতা ৭০ বছর বয়সী শাহবাজ শরিফ ।
সোমবার পাকিস্তানের সংসদের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদ থেকে ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) আইনপ্রণেতারা গণপদত্যাগ করায় বিরোধী সংসদ সদস্যদের ভোটে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।
দেশটির সংবাদমাধ্যম ডন বলছে, পাকিস্তানের ২৩ তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন পিএমএল-এনের প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ। পিটিআইয়ের সদস্যরা ভোট বর্জন করায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ১৭৪ জন আইনপ্রণেতা তার পক্ষে ভোট দেন।
এক দিন আগে অনাস্থা ভোটে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারানো ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহেরিক–ই–ইনসাফের (পিটিআই) নেতারা এ সময় অধিবেশন বর্জন করেন।
সম্মিলিত বিরোধী জোটের প্রার্থী শাহবাজ শরিফ। সোমবার পার্লামেন্টে ভোটগ্রহণের আগে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সদস্যরা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি থেকে ওয়াক আউট করেন। এর আগে তাদের প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী শাহ মেহমুদ কোরেশি নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া বয়কটের ঘোষণা দেন।
নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয় এমএনএ আয়াজ সাদিকের সভাপতিত্বে। এর আগে সোমবার সাময়িক বিলম্বের পর পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত এবং নাত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে অধিবেশন শুরু হয়। ওই সময় অধিবেশন পরিচালনা করেন ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি।
কাসিম সুরি নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনায় অপারগতা প্রকাশের পর পিএমএল-এন নেতা আয়াজ সাদিক দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নিয়েই তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের নিয়ম এবং প্রক্রিয়ার বিস্তারিত পড়ে শোনান। তিনি জানান, ভোট গ্রহণ শুরুর আগে পাঁচ মিনিট ধরে বেল বাজানো হবে, যাতে সদস্যরা অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করতে পারেন।
আয়াজ সাদিক জানান, বেল বাজা বন্ধ হলে অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ এবং বের হওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং ভোট শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত তা বন্ধ রাখা হবে।
ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী পদের প্রার্থীদের নাম পড়ে শোনান আয়াজ সাদিক। পিএমএল-এন প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ এবং পিটিআই এর শাহ মাহমুদ কোরেশির নাম ঘোষণা করেন তিনি। তবে এসময় ভুলবশত তিনি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী হিসেবে পিএমএল-এন এর সর্বোচ্চ নেতা নওয়াজ শরিফের নাম বলে ফেলেন। দ্রুত তা সংশোধন করে তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষমা চাইছি শাহবাজ সাহেব, নওয়াজের নাম আমার হৃদয়ে রয়ে গেছে।’
এরপরে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে যারা শাহবাজ শরিফের পক্ষে যারা ভোট দিতে চান তাদের বাম পাশে এবং যারা কোরেশির পক্ষে তাদের ডান পাশে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান আয়াজ সাদিক। পরে ভোট শেষে রেজাল্ট শিট পার্লামেন্ট সচিবালয়ে পৌঁছে দেওয়া হয়।
পার্লামেন্টে এই ভোটাভুটিতে শাহবাজ শরিফের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পিটিআইয়ের সহ–সভাপতি ও সদ্য বিদায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশি। তার নেতৃত্বে পিটিআইয়ের আইনপ্রণেতারা অধিবেশন বর্জন করায় শাহবাজের আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলো না। পরে ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যেখানে ১৭২ জন সদস্যের সমর্থন লাগে, সেখানে ১৭৪ জনের রায় পেয়েছেন শাহবাজ শরিফ।
এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের ২৩ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্প্রতি আলোচিত হলেও দেশের ভেতরে প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য আগে থেকেই শাহবাজ শরিফের সুনাম ছিল।
পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে, সোমবার পিটিআইয়ের এমপিরা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন বয়কট করে পার্লামেন্ট থেকে ওয়াকআউট করেন। তারা পার্লামেন্ট থেকে গণ-পদত্যাগের কথাও ঘোষণা করেন।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে পিটিআইয়ের প্রার্থী ছিলেন মাহমুদ শাহ কোরেশি, কিন্তু তাদের বয়কটের পর শাহবাজ শরিফ কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান মুসলিম লিগ নওয়াজ (পিএমএলএন)-এর নেতা ৭০ বছর বয়স্ক শাহবাজ শরিফ পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই এবং তিনি দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
শাহবাজ শরিফ রোববার প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য তার প্রার্থিতা জমা দেন। পাকিস্তানের অন্য বৃহৎ রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টির বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারিআেই তার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছিলেন।
তবে ইমরান খান তার ক্ষমতাচ্যুতির জন্য ‘বিদেশী ষড়যন্ত্র’কে দায়ী করছেন। তিনি উৎখাত হবার পর সমর্থনে পাকিস্তানের বড় শহরগুলোতে বিশাল বিশাল মিছিল বের হয়েছে।
তার ক্ষমতাচ্যুতির আগে এক সপ্তাহ ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একের পর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটে, ঘটনাপ্রবাহে হস্তক্ষেপ করে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতও ।
পাকিস্তানের ২৩ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শাহবাজ। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্প্রতি আলোচিত হলেও দেশের ভেতরে প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য আগে থেকেই শাহবাজ শরিফের সুনাম ছিল।
উনসত্তর বছর বয়স্ক ইমরান খান তার বিরুদ্ধে প্রথমে আনা একটি অনাস্থা প্রস্তাব ‘বিদেশী শক্তির প্রভাবে আনা হয়েছে’ এ যুক্তি দেখিয়ে পার্লামেন্টে আটকে দিয়েছিলেন ডেপুটি স্পিকার। এর পর মি. খান ভেঙে দিয়ে এবং নতুন নির্বাচন দিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ প্রতিহত করার চেষ্টা করেন।
কিন্তু এর বিরুদ্ধে দেশটির বিরোধীদলগুলো সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করলে, আদালত ইমরান খানের পদক্ষেপকে অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেন এবং অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটির আদেশ দেন। অনাস্থা ভোটে পার্লামেন্টের ৩৪২ জন সদস্যের মধ্যে ১৭৪ জনই ইমরান খানের বিপক্ষে ভোট দেন।
কে এই শাহবাজ শরিফ?
৭০ বছর বয়সী শাহবাজের জন্ম লাহোরে। ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের এই সন্তানের পড়াশোনা পাকিস্তানেই। পড়াশোনা শেষে পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন তিনি। বর্তমানে পাকিস্তানের একটি ইস্পাত কারখানায় যৌথ মালিকানা রয়েছে তার।
শাহবাজের রাজনৈতিক জীবন শুরু ১৯৯৭ সালে, পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ১৯৯৯ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে কারারুদ্ধ হন তিনি। পরের বছরেই সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয় তাকে।
দীর্ঘদিন নির্বাসনে থাকার পর ২০০৭ সালে নিজ দেশে ফিরে আসেন শাহবাজ। আবার পা রাখেন রাজনীতিতে। ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতে ফের পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। তৃতীয় মেয়াদে শাহবাজ প্রদেশটির মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন ২০১৩ সালে।
শাহবাজ জাতীয় রাজনীতিতে পা রাখেন তার ভাই নওয়াজ শরিফ দুর্নীতির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে পাকিস্তান ত্যাগের পর। এরপর তিনি পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) সভাপতির দায়িত্ব পান। তবে নওয়াজের বিরুদ্ধে ওই মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল বলে দাবি করে আসছে তার পরিবার ও সমর্থকেরা।
শাহবাজ শরিফের বিরুদ্ধেও একাধিক দুর্নীতির মামলা হয়েছে। ইমরান খান প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও মামলার মুখে পড়েছেন তিনি। তবে সেসব মামলায় শাহবাজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়নি।
এদিকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্কের দিক দিয়ে ভাই নওয়াজের চেয়ে শাহবাজ আলাদা বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের ভাষ্য, শাহবাজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। পারমাণবিক শক্তিধর এ দেশটিতে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত নীতিতে ব্যাপক প্রভাব রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর।
পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার পতনেও দেশটির সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার দেশটিতে বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে সেনাবাহিনী। এমনকি পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রীই এখন পর্যন্ত পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫৭
আপনার মতামত জানানঃ