শনিবার মধ্যরাতে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে পতন হয়েছে ইমরান খান সরকারের। জানা গেছে, সোমবারেই (১১ এপ্রিল) নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে বসছে দেশটির জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। ওই অধিবেশনেই স্থির হবে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর নাম।
ফলে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী এখন কে হবেন সেই জল্পনাও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। উঠে এসেছে একাধিক রাজনৈতিক নেতার নাম।
পাকিস্তানের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, আগামী ১১ এপ্রিল স্থানীয় সময় বেলা ২টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে বসবেন সংসদ সদস্যরা। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ওই অধিবেশনে সভাপতিত্ব করবেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের আয়াজ সাদিক।
তিনি জানান, রোববার দুপুর ২টার মধ্যে নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। ৩টা নাগাদ শুরু হবে স্ক্রুটিনি বা বাছাই প্রক্রিয়া। প্রথমে সোমবার সকাল ১১টায় একটি অধিবেশনে বসার আহ্বান জানান সাদিক।
জানান, এরপরই শুরু হবে নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের প্রক্রিয়া। পরে অবশ্য পাকিস্তান পার্লামেন্টের অফিশিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে জানানো হয়েছে, অধিবেশন বসবে সোমবার দুপুর ২টায়।
পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এ নিয়ে জল্পনায় একাধিক নাম সামনে আসলেও বাকিদের থেকে দৌড়ে এগিয়ে আছেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ’র সভাপতি শেহবাজ শরিফ।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ভাই শেহবাজ ইমরান খান সরকারের পতনের পর জানান, তিনি প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না। তিনি জানান, আমরা কারো বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেব না, কারো প্রতি অবিচার করব না এবং কাউকে জেলে পাঠাব না, আইন তার নিজস্ব গতিতেই চলবে।
যেভাবে পদ হারালেন ইমরান
পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হলেন ইমরান। অনাস্থা ভোটে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য ভোটের দরকার ছিল ১৭২টি। ইমরানের বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি।
পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে শনিবারের মধ্যে অনাস্থা ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের সময় রাত প্রায় ১১টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ভোটের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
তবে চরম নাটকীয়ভাবে এরপর স্পিকার আসাদ কায়সার ও ডেপুটি স্পিকার কাশিম সুরি পদত্যাগ করেন। এরপর পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির চেয়ার প্যানেলের সদস্য আয়াজ সাদিক স্পিকারের দায়িত্ব নেন। মধ্যরাতের আগেই তিনি অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া শুরু করেন।
এরইমাঝে মধ্যরাতে দুই মিনিটের জন্য অধিবেশন মুলতবি করে রোববার ফের শুরু হয় নতুন অধিবেশন। এরপর রবিবার ভোর রাতে ১৭৪-০ ভোটের ব্যবধানে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হয়।
এরপরই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত করা হয় ইমরান খানকে। এর আগে ইমরানের তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সদস্যরা অ্যাসেম্বলি ত্যাগ করেন।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটের মাঝেই মধ্যরাতে দরজা খোলা হয় পাক সুপ্রিম কোর্টের। পাক সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী আস্থা ভোট না হলে ইমরান খান, স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিশ জারি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়।
এই পরিস্থিতিতে গভীর রাতে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে ইমরান খানের সঙ্গে দেখা করে আসেন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার। ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় পাক সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার।
এরপর পাকিস্তানের স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় অ্যাসেম্বলি ভবনে পৌঁছান স্পিকার আসাদ কায়সার। ততক্ষণে পাক অ্যাসেম্বলির বাইরে প্রিজন ভ্যান মোতায়েন করা হয়। এই আবহে ইমরানের চাপের মুখে পদত্যাগ করেন স্পিকার আসাদ কায়সার।
পদত্যাগের মুহূর্তে কায়সার বলেন, ‘৩০ বছর ধরে ইমরান খানের সঙ্গে আছি। ছাত্র অবস্থায় পিটিআই-তে যোগ দিয়েছি। কীভাবে অনাস্থা ভোটের নির্দেশ দিই!’
এছাড়াও তিনি ইমরানের ‘ষড়যন্ত্রে’র তত্ত্বের উপর জোর দিয়ে একটি সাদা কাগজ দেখিয়ে দাবি করেন, এতেই প্রমাণ রয়েছে যে ‘বিদেশি শক্তি’ পাক সরকারের পতনের নেপথ্যে রয়েছে।
এদিকে আস্থা ভোট থেকে শুরু হতেই সর্বপ্রথম ভোট দেন পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আসিফ আলি জারদারি। এরপর একে একে আরও ১৭৩ জন ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সদস্য অনাস্থা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন। এরই মাঝে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ সরকারি বাসভবন ছেড়ে চলে যান।
অ্যাসেম্বলিতে ভোটাভুটির ফল প্রকাশ হতেই শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘পাকিস্তানে নতুন ভোর হতে চলেছে।’
কে এই শেহবাজ শরিফ?
পাকিস্তানের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই শেহবাজ। ৬৯ বছর বয়সী ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের লড়াইয়ে বিরোধীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে শেহবাজের, তার ভাই নওয়াজ শরিফের যা ছিল না। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, ২২ কোটি মানুষের পাকিস্তানে পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতি বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দেশটির সেনাবাহিনী।
সেখানে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা ক্ষমতায় থাকার অন্যতম চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানে।
একাধিকবার পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন শেহবাজ শরিফ। সেই সময় চিনের সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে বেইজিংয়ের সঙ্গে কাজ করেছেন শেহবাজ।
তিন দফায় ১২ বছর ধরে পাঞ্জাবের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। প্রথমে ১৯৯৭ থেকে ১৯৯৯ এবং পরবর্তীতে টানা দুই দফায় ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাঞ্জাব প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন শেহবাজ। ২০১৮ সাল থেকে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে তিনি বিরোধীদলীয় নেতার পদ সামলেছেন।
১৯৯৯ সালে পাকিস্তানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর শেহবাজকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে সৌদি আরবে নির্বাসিত করা হয়েছিল। ২০০৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
২০১৭ সালে প্রকাশিত পানামা পেপারসে নওয়াজ শরিফের নাম উঠে আসার পর শেহবাজ পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ পার্টির প্রধান হন। পাঞ্জাবের রাজনীতি ছেড়ে সেই প্রথম জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ তার।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের ভালো সম্পর্কে বিশ্বাসী শেহবাজ শরিফ। বলে রাখা ভালো, ইমরানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবের পর থেকেই পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করে এসেছেন, তার সরকারের পতনের নেপথ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে শেহবাজ তার ভাইয়ের মতোই মার্কিনপন্থী নীতিতে বিশ্বাসী।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৮
আপনার মতামত জানানঃ