করোনাভাইরাসের কারণে ৬৮ বছরে মধ্যে চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে পাকিস্তান। ২০২০ সালে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এক মোড় পরিবর্তনের আশ্বাস দিয়েছিলেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। কিন্তু করোনার ধাক্কায় পাকিস্তানের অর্থনৈতিক হাল এখন ১৯৫১-৫২ অর্থবছরের ন্যায়। দেশটির সাথে দেশটির প্রধানমন্ত্রীরও হাল যে বেশি একটা ভালো নয়, তা পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতেই স্পষ্ট হয়ে আসে।
দেশটিতে চরম আকার নিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার বহিঃপ্রবাহ আন্তঃপ্রবাহের চেয়ে অনেক বেশি। মুদ্রাবাজারে ধস নেমেছে পাকিস্তানি রুপির বিনিময় হারে। দেশটির আন্তঃব্যাংক লেনদেনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে এখন প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে রেকর্ড ১৮৯ রুপি ২৫ পয়সায়। গত জুলাইয়ে দেশটিতে চলতি অর্থবছর শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত মুদ্রাটির অবমূল্যায়ন হয়েছে ১৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ।
করাচির চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (কেসিসিআই) সাবেক প্রেসিডেন্ট, বিজনেসম্যান গ্রুপের চেয়ারপারসন এম জুবাইর মতিওয়ালা বলেন, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে ব্যবসা ও শিল্প খাত বিচলিত। রুপির মূল্য হ্রাস, রিজার্ভ কমে যাওয়া, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ রাজস্ব ঘাটতির কারণে দেশটির অর্থনীতি ইতিমধ্যে ভঙ্গুর।
পাকিস্তান সরকারের ঋণের পরিমাণও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। এতদিন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেইল আউট প্যাকেজগুলো পাকিস্তানকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করলেও এবার তাতে বাদ সেধেছে দেশটির রাজনৈতিক অস্থিরতা। আইএমএফ জানিয়েছে, স্থিতিশীল নতুন কোনো সরকারের অধীনে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগ পর্যন্ত পাকিস্তানকে বেইল আউটের অর্থ দেবে না সংস্থাটি।
আবার এ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও অদূরভবিষ্যতে স্থিতিশীলতা ফেরার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সবকিছু ঠিক থাকলে দেশটির পার্লামেন্টে আজই ইমরান খানের পতনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন তেহরিক-ই-ইনসাফের কর্মী-সমর্থকরা ঘোষণা দিয়েছে, ময়দানে ছেড়ে কথা বলবে না তারাও। সে হিসেবে সামনের দিনগুলোয় পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য পরিস্থিতি আরো কঠিন হয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক বলছেন, দেশটির অর্থনৈতিক সংকট এখন অনেকটাই শ্রীলঙ্কার পথে রয়েছে।
শ্রীলংকার মতো পাকিস্তানেও অর্থনীতির বড় সংকট হয়ে উঠেছে মূল্যস্ফীতির লাগামহীন উল্লম্ফন। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে দেশটিতে মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াতে পারে ১১ শতাংশে। এ অঞ্চলে বর্তমানে মূল্যস্ফীতির দিক থেকে শ্রীলংকার পরই পাকিস্তানের অবস্থান। যদিও ইমরান খান সরকারের লক্ষ্য ছিল এবার মূল্যস্ফীতিকে ৮ শতাংশের ঘরে রাখা।
মূল্যস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণ এ মুহূর্তে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। বাজারে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। দেশটিতে মূল্যস্ফীতির এ ঊর্ধ্বগতির জন্য বৈশ্বিক জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার বিষয়টিকেই প্রধানত দায়ী করা হচ্ছে। দুই ধরনের পণ্যের জন্যই আমদানির ওপর নির্ভরশীল পাকিস্তান। বিশেষ করে দেশটির মোট আমদানি ব্যয়ের ২০ শতাংশই যায় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে জ্বালানি পণ্য সংগ্রহে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ায় বাজারে চাপ আরো বেড়েছে। উপরন্তু যুযুধান দেশ দুটি আবার একই সঙ্গে পাকিস্তানের প্রধান খাদ্যশস্য গমের বড় সরবরাহকারীও।
শেষ তিন বছর ধরে পাকিস্তানে যে হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে, তা বিগত ৭০ বছরে দেখা যায়নি। সব খাবারের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঘি, তেল, চিনি, ময়দা এবং পোলট্রিজাত খাবারের দাম অতীতের সবে রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে।
করাচিতে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে কর্মরত রশিদ আলম বলেন, ‘কোনো কিছু ঠিক নেই। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর এটাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা।’
২০২২ সালে পাকিস্তানে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি থমকে আছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, গত বছর পাকিস্তানে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ইমরান খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। অপর দিকে গত এক বছরে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ বা ১৪৫ পাকিস্তানি রুপি।
‘কোনো কিছু ঠিক নেই। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর এটাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা।’
ফেডারাল বিউরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে, বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ভারতীয় মুদ্রায় ৪ টাকা ৬ পয়সা থেকে বেড়ে অন্তত ৬ টাকা ৩৮ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি একদিকে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়েছে অন্যদিকে চাপ ফেলেছে পাকিস্তানের ডলার রিজার্ভে। দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ এখন দ্রুতগতিতে কমে আসছে। এসবিপির ২৫ মার্চের তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন দেশটিতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল প্রায় ১ হাজার ২০৫ কোটি ডলার। চলতি মাসের শুরুতে তা নেমে এসেছে প্রায় ১ হাজার ১৩২ কোটিতে।
এর বিপরীতে বড় হচ্ছে পাকিস্তান সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ। এডিবির প্রাক্কলন অনুযায়ী, চলতি অর্থবছর শেষে পাকিস্তানের চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াতে পারে জিডিপির সাড়ে ৩ শতাংশে। ঋণমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা মুডি’সের প্রাক্কলন আরো হতাশাজনক। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, এবার পাকিস্তানে চলতি হিসাবের ঘাটতি দাঁড়াতে পারে জিডিপির ৬ শতাংশে। চলতি হিসাবের ঘাটতি বাড়তে থাকায় দেশটির ব্যাংকগুলোর জন্য ডলার সংগ্রহ করা এখন বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। রিজার্ভের পাশাপাশি দেশটির আমদানি কার্যক্রমেও এখন ছাপ ফেলতে শুরু করেছে এ ঘাটতি।
সব মিলিয়ে দেশটির সার্বিক অর্থনীতিতেই এখন শ্লথতার ছাপ। বিষয়টি অনুভূত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই। বিশেষ করে চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশটির বৃহৎ শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৩ শতাংশ। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে খাতটির প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছিল ৬ দশমিক ৯ শতাংশে। জ্বালানির অস্থিতিশীল বাজার বৃহৎ শিল্প খাতকে বিপাকে ফেললেও কিছুটা সহায়তা মিলতে পারে আবাসন নির্মাণ খাত থেকে। খাতটিতে সম্প্রতি পাকিস্তান সরকারের বিনিয়োগ ও প্রণোদনার পরিমাণ অনেকখানিই বেড়েছে। এছাড়া পাকিস্তান সরকারের নয়া পাকিস্তান হাউজিং প্রোগ্রামের অধীনে প্রণোদনামূলক ঋণ বিতরণও খাতটিতে বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।
শিল্প খাতের ধারাবাহিকতায় শ্লথতার পথে হাঁটছে দেশটির সেবা খাতও। তবে এগুলোর বিপরীতে দেশটির কৃষি খাত তুলনামূলক ভালো পারফরম্যান্স দেখাতে পারে বলে মনে করছে এডিবি।
২০১৮ সালে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তিনি কয়েক দশক ধরে চলা দুর্নীতি এবং কুসংস্কার দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে।
মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার তওসিফ আহমেদ খান বলেন, সরকার অর্থনৈতিক কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই গর্বের ভিত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে।
নির্বাচনী প্রচারণায় পাকিস্তানকে একটি কল্যাণকর ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন ইমরান খান। দরিদ্রদের জন্য সামাজিক প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য কার্যকর বাণিজ্যিক কর এবং ব্যক্তিপর্যায়ে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরান খান এ বিষয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে। তার এসব পরিকল্পনা রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব কম পরিবর্তন এনেছে।
দুই দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দশা হতে পারে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের মতো।
শনিবার জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মুখে পড়তে চলেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এই পরিস্থিতি দেখিয়ে দিয়ে শ্রীলঙ্কার সরকারকে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি করার হুমকি দিয়েছে দেশটির প্রধান বিরোধী দল সমাজি জন বলওয়েগায়ার (এসজেবি)।
রয়টার্স বলছে, শুক্রবার শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে এমন হুমকি দিয়ে এসজেবি নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা দেশের অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন। আর তা নাহলে শিগগিরই পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাব আনা হবে।
ঋণে জর্জরিত এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসাসহ বিশৃঙ্খল ঋণখেলাপি অবস্থা থেকে দেশকে মুক্ত করে আনতে আর্থিক উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়ার দাবিও তুলেছেন শ্রীলঙ্কার এই বিরোধী দলীয় নেতা।
নজিরবিহীন আর্থিক সংকটে পড়া দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকার মানুষ দুর্দশায় দিন যাপন করছে। মূল্যস্ফীতি মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে দুই কোটির বেশি মানুষের দেশটি সম্প্রতি কাগজের অভাবে স্কুল-কলেজের পরীক্ষা পর্যন্ত নিতে পারেনি।
এদিকে বর্তমানে পাকিস্তানের রুপির ওপর অতিরিক্ত চাপ, শেয়ারবাজারের পতন ও বিদেশি ক্রেতাদের নেতিবাচক মনোভাবের ফলে অর্থনৈতিক ভারসম্য বজায় রাখতে বড় রকমের হেরফের হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ফেডারেশন অব পাকিস্তান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ইফরান ইকবাল শেখ বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিদেশি ও স্থানীয় কোনো বিনিয়োগ করা যাবে না। এ মুহূর্তে শেয়ারবাজারে পতন হয়েছে এবং ডলারের বিনিময়ের হার ১৮৫ রুপি ছাড়িয়েছে। দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে সুপ্রিম কোর্টকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলেও জানান তিনি।
পাকিস্তান রেডিমেড গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান সংগঠক ইজাজ খোকার বলেন, এ পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং ইতিমধ্যে এর চাপ অনুভূত হচ্ছে। সরকারকে মাথায় রাখতে হবে, আগামী বছরের মধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জিএসপি প্লাস চুক্তি শেষ হতে যাচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭১৫
আপনার মতামত জানানঃ