যুদ্ধ মানে শুধুই যুদ্ধরত দেশের মানুষের ক্ষতি এমন নয়। কোথাও যুদ্ধ বাধলে সেই প্রভাব গিয়ে পড়তে পারে হাজার মাইল দূরের কোনো দেশের মানুষের উপরও। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে অস্থির সময় পার করছে বিশ্ব অর্থনীতি। আর তার প্রভাব পড়েছে মানুষের জীবনে।
যুদ্ধের জেরে দীর্ঘ ৬০ বছরের ইতিহাস ভেঙে আন্তর্জাতিক বাজারে মার্চ মাসে খাদ্যপণ্যের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ— মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিশ্বে ভোজ্য তেল, খাদ্যশস্য, চিনি, মাংসসহ খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির গড় হার ১৩ শতাংশ।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) জানিয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে শস্য ও ভোজ্যতেলের বাজার অস্থির হয়ে পড়ায় খাদ্যের মূল্য রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
৬০ বছর ধরে ‘খাদ্য মূল্য সূচক’ নামে একটি তালিকা প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মার্চ মাসের এই সূচকে খাদ্যশস্য, উদ্ভিজ্জ তেল এবং চিনির মতো মৌলিক জিনিসগুলোর ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির হার প্রকাশ করা হয়েছে।
এতে দেখা গেছে, ৬০ বছর আগে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে গত মার্চ মাসে খাদ্যপণ্যের দাম এক লাফে সর্বোচ্চ প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতেও রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল।
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত খাদ্যপণ্যের দামের ভিত্তিতে খাদ্যের মূল্য সূচক তৈরি করে এফএও। সূচক অনুসারে, গত মাসে তা ছিল গড়ে ১৫৯.৩ পয়েন্ট। তার আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে এই সূচক ছিল ১৪০.৭ পয়েন্ট। যা ওই সময়ের জন্য রেকর্ড বৃদ্ধি ছিল।
গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী তেলের বড় রফতানিকারক দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। কৃষ্ণ সাগর দিয়ে এসব খাদ্য পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। গত ছয় সপ্তাহ ধরে প্রতিবেশী দেশটিতে রাশিয়া আগ্রাসন চালানোয় ইউক্রেনের রফতানি স্থবির হয়ে পড়েছে।
সূচক বলছে, গত এক মাসে বিশ্বে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে ২৩ শতাংশ, খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছে ১৭ শতাংশ, চিনির দাম বেড়েছে ৭ শতাংশ, মাংসের দাম বেড়েছে ৫ শতাংশ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম বেড়েছে ৩ শতাংশ।
গত মাসে এফএও সতর্ক করে জানায়, ইউক্রেনে সংঘাতের কারণে খাদ্যের মূল্য ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। এতে অপুষ্টি বাড়ার আশঙ্কাও প্রকাশ করে জাতিসংঘের সংস্থাটি।
এফএও জানায়, তাদের খাদ্যশস্যের সূচক মার্চে বেড়েছে রেকর্ড মাত্রায় ১৭ শতাংশ। আর উদ্ভিজ্জ তেলের সূচক বেড়েছে ২৩ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। বেড়েছে চিনি ও দুগ্ধজাত পণ্যের দাম।
এ বিষয়ক এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বলা হয়, বৈশ্বিক খাদ্যপণ্য মূল্যসূচকের যাত্রা শুরু হয় আজ থেকে ৬০ বছর আগে। গত ৬০ বছরের ইতিহাসে এত অল্প সময়ের মধ্যে খাদ্যপণ্যের দামের এই পরিমাণ উল্লম্ফণ দেখা যায়নি।
বৈশ্বিক বাজারে ভোজ্য তেল, বিশেষ করে সূর্যমুখী তেল ও খাদ্যশস্যের সবচেয়ে বড় যোগান আসে রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। কিন্তু যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় এ দু’টি দেশ থেকে যোগান আসা একেবারেই কমে গেছে। ফলে এই দুই পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে চিনি-মাংস ও দুধের দামও।
কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল থেকে খাদ্যশস্যের সরবরাহে জটিলতার কারণে খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এমনিতেই ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে গত দশ বছরের মধ্যে এফএও সূচক সর্বোচ্চ ছিল।
৬০ বছর আগে রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে গত মার্চ মাসে খাদ্যপণ্যের দাম এক লাফে সর্বোচ্চ প্রায় ১৩ শতাংশ বেড়েছে। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতেও রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছিল।
খাদ্যশস্যের সরবরাহ ও চাহিদার পৃথক এক প্রাক্কলনে এফএও জানায়, ২০২০ সালে বিশ্বে গমের উৎপাদন কমে হতে পারে ৭৮৪ মিলিয়ন টন। গত মাসে এই প্রাক্কলন ছিল ৭৯০ মিলিয়ন টন। সংস্থাটির ধারণা, ইউক্রেনের শীতকালীন শস্যের অন্তত ২০ শতাংশ চাষ সম্ভব হবে না।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রুশ সেনারা। এরপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিতে শুরু করে। এতে রপ্তানি প্রবাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকটের আশঙ্কা বেড়েছে। আগে থেকেই খাদ্যসংকটে থাকা মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার ক্ষেত্রে ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নানা খাদ্যশস্য ও পণ্য উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে রয়েছে গম, উদ্ভিজ্জ তেল ও ভুট্টা ইত্যাদি। বিশ্বে এসবের রপ্তানির একটি বড় অংশ আসে এ অঞ্চল থেকে।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঘাটতির আশঙ্কায় স্প্যানিশ সুপারমার্কেটগুলো তাদের গ্রাহকদের মজুত প্রবণতা ঠেকাতে সূর্যমুখী তেল বিক্রি কমিয়ে দিয়েছে।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এই বৈশ্বিক খাদ্যসংকট সৃষ্টির জন্য অভিযুক্ত করেছে। যুদ্ধের ফলে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি বেড়েছে বলে সতর্ক করেছে ফ্রান্স।
ইউক্রেনে সংঘাতের কারণে তেল ও গ্যাসের দামও আকাশছোঁয়া। এতে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে এবং বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাইনচ্যুত হওয়ার উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সামরিকতন্ত্রী রাষ্ট্র ও যুদ্ধবাজ মানুষের অমানবিক ও সহিংস তাণ্ডবে বিশ্বের বহু দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক মৃত্যু ও রক্তপাতে নিপতিত, যারা খাদ্যের সংস্থান করা তো দূরস্থিত, জীবন বাঁচাতেই মরিয়া। রণাঙ্গনে, শরণার্থী শিবিরে, পথে পথে সংঘাতদগ্ধ এইসব বিপুল ভাসমান মানুষের জীবন কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে, খাদ্যহীনতায়।
সুষম বণ্টন আর শান্তি বিরাজমান থাকলে বিপুলা এই পৃথিবীর উর্বর ভূমিতটে উৎপাদিত খাদ্যের দ্বারা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্য অন্ততপক্ষে এক মুঠো ভাত জুটতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু শোষণ, লুণ্ঠন, যুদ্ধ, দখল, রক্তপাতের ফলে তা হচ্ছে না। হিংসা, হানাহানি ও লুটপাটের তাণ্ডবতায় শান্তি, স্থিতি, নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে মানুষের মুখের গ্রাস।
তারা বলেন, খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবকে না মিটিয়ে দীর্ঘমেয়াদী শান্তি অসম্ভব৷ শান্তি ছাড়া বিশ্বজুড়ে ক্ষুধাকে হার মানানোর সম্ভাবনাও ক্ষীণ৷ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার৷ আজ আমরা এমন একটা সময়ে বাস করি যেখানে প্রতি দিন লাখ লাখ মানুষ এই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হন৷
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৫
আপনার মতামত জানানঃ