শ্রীলঙ্কায় খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে জনসাধারণের ক্ষোভর মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। মন্ত্রিসভার সদস্যদের পদত্যাগের পর এবার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন শরিক বিভিন্ন দলের এমপিরা। মঙ্গলবার (০৫ এপ্রিল) শরিক দলগুলোর ৪০ জনেরও বেশি আইনপ্রণেতা পদত্যাগ করেছেন বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।
বিদ্যুৎ-জ্বালানি-খাদ্য-ওষুধের গুরুতর সংকটে জেরবার সাধারণ জনগণের সরকারবিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে এমপিরা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে বিবিসিকে নিশ্চিত করেছেন শ্রীলঙ্কার এমপি সাবেক প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা। মঙ্গলবার পার্লামেন্টে রাজাপাকসে ভাইদের রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা (এসএলপিপি) নেতৃত্বাধীন জোট সরকার থেকে তার দল শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম পার্টিরে সরে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
পার্লামেন্টে সিরিসেনা বলেন, ‘জ্বালানি ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের গ্যাস সহ প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিপুল ঘাটতি দেখা দিয়েছে দেশে। ওষুধের মজুত না থাকায় দেশের হাসপাতালগুলো বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।’
‘এই পরিস্থিতিতে আমাদের দল জনগণের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’
বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির গুরুতর সংকট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে শ্রীলঙ্কায় যখন দিন দিনে সরকারপতন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে, সে সময়ই এ পদক্ষেপ নিলেন এমপিরা।
এদিকে শপথ নেওয়ার ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই পদত্যাগ করলেন শ্রীলঙ্কার নতুন অর্থমন্ত্রী আলি সাবরি। মঙ্গলবার (৫ এপ্রিল) লঙ্কান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন তিনি। লঙ্কান সংবাদমাধ্যম ডেইলি মিরর এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে সাবরি বলেছেন, তিনি কেবল অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট যদি সংসদের বাইরের কোনো উপযুক্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে চান, তাহলে তিনি (সাবরি) নিজের সংসদীয় আসন থেকেও পদত্যাগ করতে রাজি।
এর আগে, চরম অর্থনৈতিক সংকটের জেরে সৃষ্ট রাজনৈতিক টানাপোড়েনে গত রোববার একযোগে পদত্যাগ করেন দ্বীপরাষ্ট্রটির মন্ত্রিসভার সব সদস্য। লঙ্কান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে ছাড়া মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্যই পদত্যাগপত্র জমা দেন।
এর পরের দিনই নতুন করে চারজনকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন লঙ্কান প্রেসিডেন্ট। অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাসিল রাজাপাকসের স্থলাভিষিক্ত হন আলি সাবরি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান জিএল পেইরিস। এছাড়া দীনেশ গুনবর্ধনে শিক্ষামন্ত্রী ও জনস্টন ফার্নান্দো মহাসড়ক মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
শ্রীলঙ্কায় মন্ত্রীদের পাশাপাশি পদত্যাগ করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর অজিথ নিভার্ড ক্যাবরালও। তিনি শ্রীলঙ্কার একজন অন্যতম নীতিনির্ধারক। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের মধ্যে ক্যাবলার গত বছরের সেপ্টেম্বরে লঙ্কান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব নেন। বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে কাজ করছিলেন তিনি।
জনসাধারণের ক্ষোভর মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর এবং মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য পদত্যাগ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের অংশ হতে সব দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। কিন্তু ক্রবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিবাদে যারা রাস্তায় নেমেছেন, তারা কেবল প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ চাইছেন। গোতাবায়ে রাজাপাকসে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়েছেন।
বিদেশি মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির গুরুতর সংকট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যের সীমাহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে শ্রীলঙ্কায় যখন দিন দিনে সরকারপতন আন্দোলন দানা বেঁধে উঠছে।
দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রজুড়ে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ক্ষোভ এবং হতাশা। প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাজারও শ্রীলঙ্কান প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এমনটিই জানানো হয়েছে।
বিক্ষুব্ধ জনতা একটি স্লোগানই দিচ্ছেন, “চলে যাও গোতা, চলে যাও।”
গোতা হলেন শ্রীলঙ্কার বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসে। বর্তমানে দেশটি যেই চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তিনি অনেকাংশেই দায়ী।
প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী শ্রীলঙ্কান নাগরিক নাধিয়ে ওয়ানদুর্গালা বিবিসিকে বলেন, ‘তাকে (প্রেসিডেন্ট) যেতে হবে, সে আমাদের কাছ থেকে সবকিছু কেড়ে নিয়েছে’। দেশব্যাপী জারিকৃত কারফিউ অমান্য করে রোববার স্বামী ও দুই মেয়েকে নিয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন নাধিয়ে।
প্রেসিডেন্টের পদত্যাগের দাবিতে হাতে তৈরি একটি পোস্টার নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দেন তিনি। এ সময় নিজের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে তার পরিবার একটি সচ্ছল জীবনযাপন থেকে দিনে দিনে এক অস্বস্তিকর জীবনযাপনের দিকে চলে যেতে লাগলেন। দিনে ১৭ ঘন্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিভ্রাট, রান্নার সময় চুলায় গ্যাস নেই, গাড়ির পেট্রোল নিতে দীর্ঘ লাইন… এ সবকিছুর জন্য দেশটির পরিবারতান্ত্রিক সরকারকেই দায়ী করছেন শ্রীলঙ্কার সাধারণ নাগরিক।
নাধিয়ে বলেন, ‘এমনকি হাসপাতালের ওষুধ ফুরিয়ে গেছে, স্কুলে পরীক্ষার কাগজ ফুরিয়ে গেছে, কিন্তু রাজনীতিবিদরা প্রতিদিনই বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছেন’।
‘গ্যাস বা কেরোসিনের জন্য তাদেরকে কখনোই দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে’, যোগ করেন তিনি।
নাধিয়ে কোনো বিক্ষোভকর্মী নন কিংবা কোনো অধিকার আদায়কারী সংগঠনের সঙ্গেও জড়িত নন। তিনি শহরের ধর্মযাজকদের জন্য কাজ করেন এবং রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু সরকারবিরোধী বর্তমান এই পরিস্থিতি তার মতো হাজারও ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি, পেশা, বিশ্বাস ও বয়সের মানুষকে এক করেছে। তাদের চাওয়া একটাই, প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ।
শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ায়, সরকার জ্বালানি ও এর মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানির জন্য অর্থ প্রদান করতে পারেনি। এর পাশাপাশি মহামারিজনিত বিধিনিষেধের কারণে দেশের পর্যটন শিল্পেরও ব্যপক ক্ষতি হয়েছে। তবে অনেকেই এ সবকিছুর সঙ্গে প্রেসিডেন্টের অব্যবস্থাপনাকেই চলমান সংকটের জন্য দায়ী করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রবর্তিত নীতিগুলোর কারণেই সংকট আরও বেড়েছে। ট্যাক্স কমানো, আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সাহায্য নিতে অনিহা ইত্যাদি নীতির সমালোচনা করছেন তারা।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পূর্ববর্তী সরকার ও প্রশাসনকে দায়ী করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট, তবে নাধিয়ের মেয়ে অঞ্জলির মতো অনেকেই বলেছেন, অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের পদত্যাগ করার এবং বর্তমান পরিস্থিতির সম্পূর্ণ দায় স্বীকার করার সময় এসেছে।
আর এই ক্ষোভ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, রাজাপাকসে সরকার সরকারবিরোধী যেকোনো সমালোচনা ও প্রতিরোধ শক্ত হাতে দমনের চেষ্টা করছে। লোক জমায়েত বন্ধ করতে রোববারের কারফিউ ছিল সরকারের দমননীতির একটি পদক্ষেপ মাত্র। এ সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সেইসঙ্গে প্রেসিডেন্টের বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, কর্তৃপক্ষের লিখিত অনুমতি ছাড়া ‘জনসাধারণের কেউ রাস্তায়, পার্কে, ট্রেনে বা সমুদ্রের তীরে’ জমায়েত হতে পারবে না।
নাধিয়ে এবং অঞ্জলি এমন কয়েকশ সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছিলেন যারা প্রেসিডেন্টের আদেশ অমান্য করে বিক্ষোভে অংশ নিতে রাস্তায় নেমে আসেন।
মাহিন্দা রাজাপাকসে এর আগে দুইবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। আর গোতাবায়ে রাজাপাকসে তখন ছিলেন দেশের প্রতিরক্ষা সচিব। এ সময় তার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে, যার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীলঙ্কায় প্রায় গৃহযুদ্ধ লাগতে বসেছিল।
এছাড়াও, দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে কঠোর পন্থায় ভিন্নমত দমনের অভিযোগও রয়েছে।
বৃহস্পতিবারের বিক্ষোভের পরপরই শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। নিরাপত্তা বাহিনীকে দেওয়া হয় গ্রেপ্তার ও আটকের ব্যাপক ক্ষমতা। প্রদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারফিউ লঙ্ঘনের জন্য শনিবার থেকে রোববার পর্যন্ত রাতারাতি ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতেই এই পদক্ষেপ নিতে হয়েছে সরকারকে।
এদিকে লন্ডনভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো বলছে, গ্রেপ্তারকৃতদের অনেককেই হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
শ্রীলঙ্কা তার স্বাধীনতা-উত্তর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। দেশটির নেতারা এ সংকটকে ২০১৯ সালের এপ্রিলের ইস্টার বোমা হামলা ও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কোভিড-১৯ মহামারির ফল বলে দাবি করে দায় এড়াতে চাইলেও বাস্তবতা আদতে তা নয়।
নিশ্চিতভাবেই এ দুটি ধাক্কা দেশের পর্যটনশিল্পে উল্লেখযোগ্যভাবে পর্যটনপ্রবাহকে হ্রাস করেছে এবং অর্থনৈতিক খাতে এটি কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
কাপড় ইস্ত্রি করার জন্য পুরোনো কাঠকয়লার আয়রন মেশিন আর কেরোসিন দিয়ে জ্বালানো বাতির ব্যবহার বাড়ছে শ্রীলঙ্কায়। অনেকের কাছে এটি সৌখিন বলে মনে হলেও আসলে চরম আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট, গ্যাস ও পানির তীব্র সংকট, খাদ্য সংকট, প্রয়োজনীয় পণ্যের আকাশচুম্বী দামসহ নানা সমস্যার বেড়াজালে আটকা পড়েছে শ্রীলঙ্কার মানুষ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৪০৭
আপনার মতামত জানানঃ