ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান দেশটিতে একটু একটু করে বড় হওয়া ‘গণতন্ত্র শিশু’টির গলা টিপে ধরেছেন। নিজের দম্ভ আর কারিশমা দেখাতে গিয়ে হত্যা করেছেন গণতান্ত্রিক পরিবেশ। ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার শপথ নিয়ে ক্ষমতায় আসা ইমরান খান তার অনুগত স্পিকার ও প্রেসিডেন্টকে ব্যবহার করে যে সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি করেছেন, তা পাকিস্তানকে কোথায় নিয়ে ঠেকায়- এ নিয়ে ঘোর সংশয় তৈরি হয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘বিকৃত গণতন্ত্র’ বলে দেশটির প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য ডনের সম্পাদকীয়তে বর্ণনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে সংবাদমাধ্যমটিতে এক বিশেষ নিবন্ধে গণতন্ত্র হত্যার জন্য ইমরান খানকে দায়ী করা হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত কিছুদিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ হলেও ইমরান খান ও বিরোধী জোটের নেতা দুজনই ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করছেন বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
আপাত দৃশ্যমান যে, পাকিস্তানের রাজনীতিতে বর্তমানে ধর্মের তাস ভালোই খেলা হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, এবারই কি প্রথম পাকিস্তানে এমন হচ্ছে?
বিবিসির খবরে বলা হয়, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজের গবেষণাপত্র ‘দ্য রোল অব রেলিজিয়ন ইন পাকিস্তান’স পলিটিক্যাল ডেভলপমেন্টে’- বি এম চ্যাংপা লিখেছেন যে দ্বিজাতি তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। তবে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট এই তত্ত্ব তার গুরুত্ব হারায়, যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকাশ্যে বলেছিলেন, ধর্ম কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়।
পরে আহমদিয়াবিরোধী দাঙ্গা, রেজোলিউশনের উদ্দেশ্য, মৌলিক নীতি কমিটির প্রতিবেদন এবং ১৯৬২ সালের সংবিধান পাকিস্তানের রাজনীতিতে শক্তিশালী ভূমিকা রাখে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আসন্ন নির্বাচনের কথা চিন্তা করেই ধর্মকে তারা ব্যবহার করছেন— কারণ এর আগের নির্বাচনে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাবাইক বিপুল ভোট পেয়েছিল।
লাহোর ইউনিভার্সিটি অব ম্যানেজমেন্ট সায়েন্সের সাথে যুক্ত ইতিহাসের অধ্যাপক আলী উসমান কাসমি বলছেন, এ দেশের ভিত্তিই যখন মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে এর আলাদা পরিচয়, তখন কোনো না কোনোভবে তা ধর্মের সাথে যুক্ত থাকবেই।
অধ্যাপক আলি কাসমি মন্তব্য করেন, ‘আমরা এমন একটা বাস্তবতার মধ্যে আছি যেখানে প্রতিযোগিতা নির্ভর করবে ধর্মকে কারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারবে, তার ওপর।’
কাসমি বলেন, গত ৭০-৭৫ বছর ধরে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে। মৌলিক নীতিগুলো দিয়েই এর শুরু। তারপর আইয়ুব খানের আমলে, একটি নতুন রূপ গ্রহণ করা হয়, যার মাধ্যমে একটি নতুন ইসলামের রাজনীতি চলে। এতে আইয়ুব খান নিজেকে কামাল আতাতুর্কের মতো করে উপস্থাপন করেন। তারা আধুনিক ইসলাম ও মোল্লাদের ইসলামের মধ্যে একটি বিরোধ শুরু করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করেন এবং রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের ভূমিকাকে অন্তর্ভুক্ত করেন।
আলী উসমান কাসমির মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানকে উপমহাদেশের মধ্যে মুসলমানদের আপনভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার একটা প্রয়াস দেখা যায়। পরবর্তী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ হয়ে মুসলমানদের একটা বড় অংশ আলাদা হয়ে যায়। এছাড়া ভারতেও বিপুল সংখ্যক মুসলমান রয়েছে। এরপর যেটা দাঁড় করোনোর চেষ্টা করা হয় তা হলো— পাকিস্তান হলো প্রকৃত মুসলমানদের আবাসস্থল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পরাজয় পাকিস্তানের বেসামরিক জনগোষ্ঠী ও সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছিল। অনেকের ধারণা জন্মায় ধর্মের সঙ্গে দূরত্বের কারণেই যুদ্ধে হার হয় পাকিস্তানের।
সেই সময়ের যুদ্ধবন্দীদের আত্মজীবনী পাঠ করে দেখা যায় যে তারা ধর্ম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ১৯৭১ সালের পর ধর্মের উল্লেখ এবং ধর্মীয় তাস ব্যবহারের বিষয়টি আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। সেটা আহমদিয়া মুসলমানদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণা করা হোক, জুমার দিনে সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণা করা হোক বা মদ নিষিদ্ধ করা হোক।
২০১৮ সালে যখন ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ পাকিস্তানে ক্ষমতায় আসে, তখন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা করেছিলেন যে তার সরকার মদিনার (নবী মোহাম্মদের (সা.) সময়ে) সরকারের মতো চলবে এবং বিভিন্ন বক্তব্যে এর উল্লেখও করেন তিনি।
আলি কাসমি বলছেন, ক্ষমতায় আসার পর ইমরান খান পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্মকে নতুন রঙ ও স্টাইলে দাঁড় করিয়েছিলেন। এখন আর তা কোনো দলের হাতে নেই। ইমরান খান বিষয়টি তুললেও এখন তার বিরোধীরাও রিয়াসাত-ই-মদিনা স্লোগান ব্যবহারের জন্য উদগ্রীব।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি ইসলামাবাদের উস্তাদ হাসান আল আমিন বলেন, ইমরান খান প্রথমে কিছু বক্তব্য দেন এবং পরে তিনি ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এটা খুব বিভ্রান্তিকর। স্বল্পমেয়াদি লাভের জন্য এভাবে ধর্মকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, খুব কম মানুষই আছে যারা যৌক্তিকভাবে চিন্তা করে। এইসব বক্তব্য শুনে বেশিরভাগই মনে করে ন্যায়ের পক্ষে আছে আর অন্যদিকে শয়তান ও ধর্মের শত্রু রয়েছে, এবং শেষ পর্যন্ত, বিতর্কটি ইসলাম এবং অবিশ্বাসের দিকে যায়।
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত কিছুদিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ হলেও ইমরান খান ও বিরোধী জোটের নেতা দুজনই ধর্মকে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করছেন।
হাসান-উল-আমিনের মতে, যখন ধর্মীয় দলগুলো ধর্মীয় কার্ড ব্যবহার করে, তখন তাদের একটি এজেন্ডা থাকে, তাদের একটি ইশতেহার এবং কর্মসূচি থাকে। কিন্তু পিটিআই এমন উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরিই হয়নি, এটা তাদের মূল উদ্দেশ্য নয়।
তারা স্বল্পমেয়াদি স্বার্থ এবং সুবিধার জন্য মানুষকে প্ররোচিত করছে, যা অত্যন্ত ক্ষতিকারক।
পাকিস্তানে অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমুখি ইমরান খান ও বিরোধী দলীয় নেতা ফজলুর রহমান ধর্মীয় বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা কি আসন্ন নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে? তাও যখন ধর্মীয় দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক গত নির্বাচনে ভালো ভোট পেয়েছে?
আলি কাসমি বলছেন, পাকিস্তানের রাজনীতি আবার সেই পথেই হাঁটছে, যেখানে কে সবচেয়ে বেশি ধর্মকে ব্যবহার করতে পারে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা হবে। আগামী নির্বাচনেও এই বিষয়টি সত্য প্রমাণিত হবে।
লেখক ও গবেষক আয়শা সিদ্দিকা বলেন, ‘ধর্মকে যে ব্যবহার করতে পারবে, তুরুপের তাস তার হাতেই থাকবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পাকিস্তানের রাজনীতির ধরণই এরকম, কারণ ধর্ম বাদে মানুষকে আমরা আর কিছু দিতে পারি না। পাকিস্তানে পিএমএল-এন, জেইউআই ও পিটিআই – সব দলই ধর্মকে ব্যবহার করেছে।’
পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ইমরান খানের জনপ্রিয়তায় কিছুটা ভাটা পড়লেও পাকিস্তানের রাজনীতিতে এখনো ইমরান খানকে একটি বড় শক্তি বলেই মনে করা হচ্ছে।
এদিকে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাবটি ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি বাতিল করায় দেশটিতে গভীর সাংবিধানিক সংকট তৈরি হয়েছে। দ্য ডনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে ইমরান খান আদালতের হাতে সঁপে দিয়েছেন। এখন রাজনীতিবিদরা আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন- তাদের কী করা উচিত আর কী উচিত নয়, সেসব বিষয়ে আইনপ্রণেতাদেরই এখন সিদ্ধান্ত জানাবেন সর্বোচ্চ আদালত। এটি সাংবিধানিক রাজনীতির বিকৃতি।
দ্য ডনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, এমন একজন নেতার (ইমরান খান) নির্দেশে পার্লামেন্টারি প্রক্রিয়াকে বিকৃত করা হলো, যিনি এটি গভীর অবজ্ঞার সঙ্গে আঁকড়েও ধরেছেন। যে কারণে পাকিস্তান একটি সাংবিধানিক সংকটের অতল গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হলো। মনে হয়, আগে থেকেই তিনি এই খেলার পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন।
পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ কোন পথে যাবে, তা এখন নির্ভর করছে সুপ্রিম কোর্টের ওপর। অনাস্থা প্রস্তাব নাকচ ও পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার ঘটনাকে আদালতের আওতাধীন বলে মত দিয়েছেন দেশটির প্রধান বিচারপতি বান্দিয়াল। এখন তার ঘটনার ওপর শুনানি করছেন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৫১
আপনার মতামত জানানঃ