সুনামগঞ্জের পর এবার বানের জলে তলিয়ে যাচ্ছে সিলেটের হাওরগুলো। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে নদীর পানি। বাড়তে থাকা পানি এখন সিলেটের বিভিন্ন হাওরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ফলে হাওরের আধা-পাকা ও কাঁচা বোরো ফসল পানিতে নিমজ্জিত হচ্ছে।
উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানিতে নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলেরও বোরো ফসল পানিতে ডুবছে। হুমকির মুখে পড়েছে বেশ কয়েকটি ফসল রক্ষা বাঁধ।
নেত্রকোণার খালিয়াজুরী উপজেলা সদরের কয়েকটি হাওরের নিচু জমির প্রায় ৫০০ একর জমির বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। এভাবে ঢলের পানি অব্যাহত থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে উপজেলার ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসলই তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। ইতোমধ্যে ১১৩ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ৩০ মার্চ থেকে ২ এপ্রিলের মধ্যে এসব জমি তলিয়ে যায়।
প্রতিবছর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তিতেও যথাযথ পদক্ষেপ নেই কোনও। মেট্রো রেল, ফোর লেন সড়কের বাংলাদেশে কৃষকদের দিকে ফিরে তাকানোর সময় নেই কর্তৃপক্ষ। অথচ ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে দেশের কৃষিব্যবস্থা। নতুন প্রজন্ম মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষিকাজ থেকে।
হাওরাঞ্চল এবং আমাদের কৃষি নির্ভরতা
মো. দিলওয়ার হোসেন বাবর লিখেছেন, হাওর মূলত প্রত্যেকটিই এক একটি প্রাকৃতিক হ্রদ। ইহা হচ্ছে মূলতঃ এক ধরনের বিস্তৃত জলমগ্ন কিংবা জলশূন্য ভূমি কিংবা নিম্ন জলাভূমি। প্রতিটি হাওরই সাধারণতঃ গভীর নদী বা খালের পাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকে। হাওরগুলো গভীরতায় খুব বেশি নয়। বর্ষাকালে হাওরগুলোকে সাগরের মত মনে হয়। তখন যেদিকেই চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। শীত মৌসুমে হাওরে পানি থাকে না। তখন থাকে শুধু বিশাল আকৃতির ফসলের মাঠ।
আমাদের বাংলাদেশ মূলত একটি কৃষি প্রধান দেশ। কৃষিই হচ্ছে এই দেশের মানুষের প্রধান পেশা এবং অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। কথায় বলে ভাতে-মাছে বাঙালি। অর্থাৎ ভাতই হচ্ছে আমাদের প্রধান খাদ্য। আর এই প্রধান খাদ্য আমরা পেয়ে থাকি ধান থেকে। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে সাধারণত এই ধান বেশি করে উৎপাদিত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সাতটি জেলা নিয়ে এই হাওরাঞ্চল গঠিত। এই সাতটি জেলা হচ্ছে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই অঞ্চলটি এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ হাওরাঞ্চল নামে পরিচিত। বাংলাদেশের এই হাওরাঞ্চলে ছোট বড় মিলে চার শতাধিক হাওর রয়েছে।
এই হাওরাঞ্চলের আয়তন ৮ লাখ ৫৮ হাজার, ৪৬০ হেক্টর। হাওরের মাটি পলি দ্বারা গঠিত বলে খুবই উর্বর এবং এই অঞ্চলে বছরে প্রায় ৩ লাখ টন খাদ্য উৎপাদিত হয়। যা দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই এই অঞ্চলটি বাংলাদেশের খাদ্য গুদাম বা বোরো ধানের শস্য ভান্ডার হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ এই হাওরাঞ্চলের সাতটি জেলার মধ্যে ৪টি জেলাই রয়েছে সিলেট বিভাগে। এই ৪ জেলা নিয়ে সিলেট বিভাগের হাওরাঞ্চলে ছোট বড় মিলে ৪২৪টি হাওর রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে জানা গেছে এই মৌসুমে সিলেট বিভাগের চার জেলায় ৪ লক্ষ ৮৫ হাজার ৪৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে তন্মধ্যে সুনামগঞ্জ জেলায় সর্বাপেক্ষা বেশি জমিতে আবাদ করা হয়েছে।
সূত্রের হিসাব অনুসারে সুনামগঞ্জ জেলায় ২ লক্ষ ২২ হাজার ৬৯৫ হেক্টর, হবিগঞ্জ জেলায় ১ লক্ষ ২২ হাজার ৩ শত হেক্টর, সিলেট জেলায় ৮৩ হাজার ৭ শত হেক্টর এবং মৌলভীবাজার জেলায় ৫৬ হাজার ৮ শত হেক্টর জমিতে এই বৎসর ধান চাষ করা হয়েছে।
কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রত্যাশা করছেন, এই বছর যদি আবহাওয়া অনুকূলে থাকে এবং কৃষকরা যদি ঠিকমত তাদের ফসল কেটে ঘরে তুলতে পারে তাহলে চার জেলায় মোট ১৯ লক্ষ ৮৫ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন চাল উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন হাওরের ‘মা’ বলে খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলা থেকে পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
সূত্রমতে এই বৎসর সুনামগঞ্জ জেলায় ৯ লক্ষ ১ হাজার ৪৮১ মেট্রিকটন, হবিগঞ্জ জেলায় ৫ লক্ষ ২২ হাজার ১০৯ মেট্রিক টন, সিলেট জেলায় ৩ লক্ষ ৩২ হাজার মেট্রিক টন এবং মৌলভীবাজার জেলায় ২ লক্ষ ২৯ হাজার ৪০৯ মেট্রিক টন চাউল উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অকাল বন্যা, বেড়ি বাঁধ ও সর্বস্বান্ত কৃষক
হাওর অধ্যুষিত এই সুনামগঞ্জ জেলায় ফসলের মৌসুমে বরাবরই প্রবল বৃষ্টি, অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে এই অঞ্চলে দেখা দেয় অকাল বন্যা। মার্চের দিকে শুরু হওয়া এই অকাল বন্যার কারণে হাওরের বোরো ধান অসময়ে পানিতে ভেসে যায়। যা সুনামগঞ্জের জন্য একট অন্যতম প্রাকৃতিক সমস্যা।
এই সমস্যাকে উপেক্ষা করে চলার কোন উপায় নাই। তাই বৃহত্তর সিলেটের শষ্য ভান্ডার সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলকে অকাল বন্যাসহ সকল প্রকারে প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য নানাবিধ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় প্রতি বছরেই। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হাওরের ফসল রক্ষা বাধ নির্মাণ বা বেড়ি বাঁধ তৈরিকরণ।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে সুনামগঞ্জ জেলায় হাওর রক্ষা বাঁধ বা ডুবন্ত বেড়ি বাঁধের পরিমাণ ১ হাজার ৬৮০ কিলোমিটার। এর অধিকাংশ বাঁধই বর্ষাকালে পানির নিচে তলিয়ে যায়। আর এই বাঁধই হল অকাল বন্যার হাত থেকে ফসলকে বাঁচানোর একমাত্র পন্থা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে জেলার ১২টি উপজেলার বিভিন্ন হাওরেরর বোরো ফসল রক্ষা করার জন্য এবার ৭২৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি জেলার ১৩০টি ঝুঁকিপূর্ণ ক্লোজার সহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ এবার নির্মাণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে। এই জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ১১০ কোটি ৮৪ লক্ষ টাকা।
এই বেড়ি বাঁধ বা ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করার জন্য প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০২০-২০২১ অর্থ বছরেও জেলার ৭৮০টি পিআইসির মাধ্যমে ৬১৩ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ ও সংস্কার করার জন্য ১২৫ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।
নীতিমালা অনুযায়ী একটি নির্দিষ্ট বছরের বা মৌসুমের ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধ নির্মাণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু কোন বছরেই এই কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এবং সঠিক নিয়মে ও প্রক্রিয়ায় সম্পাদিত হয় না। ফলে হাওর পাড়ের কৃষকরা উৎকণ্ঠায় ও দুশ্চিন্তায় দিন কাটায়।
কর্তৃপক্ষের অবহেলা, গাফিলতি, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির কারণে অনেক বৎসর দেখা যায় যে, সঠিক সময়ে পিআইসি গঠিত হয় না, সময়মত বরাদ্দ ছাড় করা হয় না অথবা যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্দও দেওয়া হয় না। ফলে সঠিক সময়ে কাজ শুরু হয় না এবং শেষও হয় না। তাছাড়াও দেখা যায় যে অনেক সময় সঠিক পরিমাণ উচ্চতা, প্রশস্ততা ও দৈর্ঘ্যও ঠিক থাকে না। ফলে অকাল বন্যা দেখা দিলে বাঁধ উপচিয়ে পানি পড়ে অথবা অতি সামান্য পানির চাপেই বাঁধ ধ্বসে যায় ও ভেঙ্গে যায়। ফলে কোটি কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়ে কৃষকেরা সর্বস্বান্ত হয়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৭২০
আপনার মতামত জানানঃ