নগর সভ্যতার ডামাডোলে গোটা বিশ্ব এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যেখানে প্রাণ ধারণের জন্য ন্যূনতম বিশুদ্ধ আলো, বাতাস ও পানির মতো প্রকৃতির অফুরান দানগুলো অবশিষ্ট থাকার সুযোগ নেই। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে নানা বিরূপ প্রভাবসহ মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কবলে পড়ে ক্রমেই হুমকির মুখে এগিয়ে চলছে জনজীবন। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও দ্রুত শিল্পায়নের এই অশুভ প্রতিযোগিতার করাল গ্রাসে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে, লাগামহীনভাবে বেড়ে চলছে দূষণ।
বিশ্বের প্রায় সব মানুষই দূষিত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সোমবার(০৪ এপ্রিল) এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি বলেছে, বিশ্বের ৯৯ শতাংশ মানুষ মারাত্মকভাবে দূষিত বায়ুতে শ্বাস নেয়। প্রতি বছর বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পেছনে এই বাতাসের খারাপ মানকে দায়ী করেছে সংস্থাটি।
জাতিসংঘের স্বাস্থ্যবিষয়ক এই সংস্থার নতুন তথ্যে দেখা গেছে, বিশ্বের প্রত্যেক প্রান্তেই মানুষ বায়ু দূষণ মোকাবিলা করছে। তবে দরিদ্র দেশগুলোতে এই সমস্যা আরও প্রকট।
বলা হয়েছে, বিশ্বের ১১৭টি দেশের প্রায় ছয় হাজারের বেশি শহরের বায়ুর গুণমান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও এসব শহরে বসবাসকারী লোকজন দূষিত বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছে।
সংস্থাটির পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যবিষয়ক পরিচালক মারিয়া নেইরা সাংবাদিকদের বলেছেন, বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ১০০ ভাগই এখন এমন বায়ুতে শ্বাস নিচ্ছেন; যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশকৃত বায়ুমানের চেয়েও খারাপ।
তিনি বলেন, ‘এটি একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা।’ চার বছর আগের প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, বিশ্বের জনসংখ্যার ৯০ শতাংশেরও বেশি বায়ু দূষণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
ডব্লিউএইচও বলেছে, ‘বায়ু দূষণের কারণে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির প্রমাণের ভিত্তি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অনেক বায়ু দূষণকারী এমনকি নিম্ন স্তরের দূষণের কারণেও উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করছে।’
যদিও গত বছর জাতিসংঘের তথ্যে বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির লকডাউন এবং দেশে দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার ফলে বায়ু মানের সাময়িক উন্নতি ঘটেছে বলে জানানো হয়। তারপরও বায়ু দূষণ বড় ধরনের সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
মারিয়া বলেছেন, ‘মহামারি থেকে বাঁচার পরও বায়ু দূষণের কারণে বছরে এখনও ৭০ লাখ প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটছে।’
গত বছর ডব্লিউএইচও তার বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইন পরিবর্তনের পর জানায়, পিএম২.৫ নামে পরিচিত ছোট এবং বিপজ্জনক বায়ুকণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে এরচেয়েও কম ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হতে পারে।
‘মহামারি থেকে বাঁচার পরও বায়ু দূষণের কারণে বছরে এখনও ৭০ লাখ প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটছে।’
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ার বলছে, বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি। প্রত্যেক বছর বিশ্বজুড়ে ৭০ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে বায়ু দূষণের কারণে।
মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন— প্রাণঘাতী ক্যান্সার এবং হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে পিএম-২.৫। আইকিউএয়ার বায়ূতে পিএম-২.৫’র যে উপস্থিতি পেয়েছে তা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বলে সতর্ক করে দিয়েছে।
গত মাসের শেষের দিকে ২০২১ সালে বিশ্বের ১১৭টি দেশ, অঞ্চল ও ভূখণ্ড এবং ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান নিয়ে বিশ্লেষণ করে আইকিউএয়ার বিশ্বের শীর্ষ বায়ু দূষণের দেশ এবং রাজধানীর তালিকা প্রকাশ করে। এই তালিকায় টানা চতুর্থবারের মতো ২০২১ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তকমা পেয়েছে বাংলাদেশ।
আইকিউএয়ার বলছে, ২০২১ সালে বিশ্বের কোনো দেশই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি।
রাজধানী ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে অবস্থান করছে। বিশ্বে শীর্ষ দূষিত কয়েকটি শহরের অন্যতম ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সর্বাধিক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মানুষের গড় আয়ু কমছে দীর্ঘমেয়াদী বায়ুদূষণের কারণে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু সবচেয়ে বেশি কমেছে। চীন, ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মিয়ানমার ও ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বায়ুদূষণের কারণে বেশি কমছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি নগরায়ন ও শিল্পায়নের হার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষঙ্গ হিসেবে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণের মাত্রাও বেড়েছে বহুগুণে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, পৃথিবীর শতকরা প্রায় ৯১ ভাগ মানুষ সংস্থাটির নির্ধারিত মান মাত্রার নির্মল বায়ু সেবন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি বছর বায়ুদূষণের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির প্রায় ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বায়ুদূষণ প্রকট আকার ধারণ করছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর কাছে যানজটের পাশাপাশি আরেক যন্ত্রণার নাম বায়ুদূষণ। মাত্রাতিরিক্ত দূষণের কবলে নগরজীবন বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছে। বাড়িয়ে তুলছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে শিশু, বৃদ্ধ ও শ্বাসতন্ত্রের রোগীরা।
প্রতিনিয়ত বায়ুদূষণে ফুসফুসের অক্সিজেন গ্রহণক্ষমতা কমে শ্বাসকষ্ট ক্রমাগত বাড়ে বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, প্রথমে শ্বাসনালি ও চোখে সমস্যা তৈরি করে। ফলে অ্যাজমা ও নিউমোনিয়ার রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এ দূষিত বায়ু গ্রহণ ব্রঙ্কাইটিস থেকে ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে বলে উল্লেখ করেন। এদিকে বায়ুদূষণের কারণে ক্রনিক অবস্ট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) বেশি দেখা দেয় বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
এ জন্য বায়ুদূষণের সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুর বিষয়টি জড়িত। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে কিন্তু সেটা কতটা মানসম্মত সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত। আমাদের জীবদ্দশায় কতটা সময় হাসপাতালে কাটাতে হয়, সেটাও হিসাব করা উচিত বলে জানান তারা।
নির্মল বায়ুর জন্য স্থায়ী কোনো নীতি যেটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে পারে, সেটা গড় আয়ু বাড়ানোর পাশাপাশি জলবায়ুর ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। তারা এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে চীনকে উল্লেখ করে বলেছেন, ২০১১ সালের তারা যে নীতি গ্রহণ করেছে, তাতে তাদের গড় আয়ু বেড়েছে ২.৬ বছর।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৪
আপনার মতামত জানানঃ