শীতের শুরুতেই বাংলাদেশে আবহাওয়ার পরিবর্তন উদ্বেগজনক চেহারা ধারণ করছে। অস্বাস্থ্যকর বায়ু ও পরিবেশে ঢাকা এমনিতেই সামনের সারিতে। কিন্তু বছরের এ সময়টাতে ঢাকা চলে যাচ্ছে সবার ওপরে। বায়ুদূষণে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিকে পেছনে ফেলে গতকাল সোমবার এক নম্বরে উঠে এসেছে ঢাকার নাম। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে বেড়ে গেছে ধূলিকণার পরিমাণ। ফলে বছরের এ সময়টাতে এসে বায়ু দূষণ চরম রূপ ধারণ করছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচক (একিউআই) অনুযায়ী, ৭ ডিসেম্বর ২০২০, গতকাল সোমবার ঢাকায় বায়ুদূষণের মানমাত্রায় আবারও সবার ওপরে উঠে এসেছে। এদিন বেলা ৩টার দিকে মানমাত্রা ২৬৯-এ উঠে আসে। যা গত রবিবার ছিল ২৩৮। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে দিল্লি (২৬২) আর তৃতীয় অবস্থানে করাচি (২৪২)। এই মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ বিপজ্জনক।
এর আগে গত ২১ নভেম্বর ঢাকা দূষণে এক নম্বরে উঠে এসেছিল। এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুমান সূচক একিউআই অনুযায়ী, গত ২১ নভেম্বর ২০২০ ঢাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা ছিল ৩১৫। সেদিন কলকাতা ছিল তৃতীয় অবস্থানে, তার বায়ু মানের মাত্রা ছিল ১৮৬, মুম্বাইয়ে এটা ছিল ১৬৯, আর দিল্লিতে ১১২।
২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর রাত পৌনে নয়টায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে দিল্লির অবস্থান ছিল চতুর্থ, আর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার অবস্থান ছিল প্রথম। এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সেদিন সকাল সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় ঢাকাই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। এরপর কয়েক ঘণ্টার জন্য মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলানবাটোর ও ভারতের কলকাতা শহর দূষণের দিক থেকে ঢাকাকে ছাড়িয়ে যায়। তবে রাত সাড়ে আটটার পর ঢাকা আবার শীর্ষে চলে আসে।
তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শীতকালে ঢাকার বায়ুমান একেবারে নিচের দিকে নেমে যায়। শীতে পরিস্থিতির অবনতি অন্যান্য দেশও কমবেশি প্রত্যক্ষ করে। তাই তারা এ সময়ের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেয়, জরুরি ব্যবস্থাদি গ্রহণ করে। শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, নাগরিকদের ঘরে থাকতে উৎসাহিত করা এবং করণীয় সম্বন্ধে ব্যাপক প্রচার চলে। কিন্তু বাংলাদেশে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণই সার। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় জোরদার কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। আবার নাগরিকদের সচেতন করার উদ্যোগও সীমিত। সরকারি, বেসরকারি উভয় তরফেই ঢাকার বায়ুদূষণ প্রতিরোধে কার্যকর কিছু চোখে পড়ছে না।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকায় ঘিঞ্জি পরিবেশের কারণে বাতাস চারদিকে ছড়াতে পারে না। এতে বাতাসে ধূলিকণার উপস্থিতি ভারী হচ্ছে। এছাড়া ফিটনেসবিহীন গাড়ি অধিক মাত্রায় কার্বন উৎপাদন করে। বস্তি এলাকায় কাঠের চুলায় সৃষ্ট ধোঁয়ায় আরেক দফা বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। তবে শীতের শুরুতেই ঢাকার এমন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের কপালে ভাঁজ ফেলছে। আমরা ঢাকার এ আবহাওয়াকে দুর্যোগপূর্ণ বলে মনে করছি। এখনই এ দূষণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে শীতকালজুড়ে অর্থাৎ আগামী তিন মাসে ঢাকার পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। তখন দেখা যেতে পারে বায়ু দূষণে নির্বিচারে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি।
নানা শঙ্কার কথা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা আরও বলছেন, ছয় ধরনের পদার্থ ও গ্যাসের সমন্বয়ে ঢাকায় দূষণের মাত্রা সম্প্রতি অনেক বেড়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ধূলিকণা অর্থাৎ পিএম ২.৫-এর কারণেই ঢাকায় দূষণ আগামী তিন মাসে অতিমাত্রায় বেড়ে যাবে এবং বাড়বে মৃত্যুর হার। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীবাসী, বিশেষ করে শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে দেখা দেবে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। উল্লিখিত তিন মাস মশারির মতো ক্ষতিকারক ছয় ধরনের পদার্থ ও গ্যাসে সব চেয়ে বেশি আচ্ছন্ন থাকবে ঢাকার বাতাস।
ঢাকার বায়ুমানের যে অবস্থা, এরকম বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করলে অন্যদের পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যানসার, শ্বাসকষ্টজনিত রোগ (সিওপিডি), চোখের সমস্যা, ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়াসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকবে বেশি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীরাও ফুসফুসের উন্নতির ক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকিতে পড়বে।
এসডাব্লিউ/আরা/১০৫০
আপনার মতামত জানানঃ