আইন ও সালিশ কেন্দ্র হিসাব দিয়েছে যে ২০২০ সালে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে, অর্থাৎ গ্রেপ্তারের পর নিহত হন ১১ জন। এ ছাড়া গ্রেপ্তারের আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মারা যান ৫ জন এবং গুলিতে নিহত হন ৮ জন। ২০১৯ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মোট ১৮ জন মারা গিয়েছিলেন; ২০১৮ সালে ১৭ জন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চার বছরে ২৬০ জন হেফাজতে মারা যান, ২০১৬ সালে এক বছরেই মারা যান ৭৮ জন। যদিও এই সব মৃত্যু এখন পরিসংখ্যান মাত্র।
দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা বন্দুকযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা আগের থেকে কমলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু আবারও অত্যন্ত উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে বলে সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মার্চ মাসের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা পর্যালোচনা করে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ মার্চ) ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট আইনজীবী সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে বলা হয়, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা, পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু, কারা হেফাজতে মৃত্যু, সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিংসতা, সীমান্তে হতাহতের মতো ঘটনা বন্ধ হয়নি বরং বেড়েছে।
কী বলা হয়েছে প্রতিবেদনে?
বৃহস্পতিবার প্রকাশ করা সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ধর্ষণসহ নারী ও শিশুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মানুষের বস্তুনিষ্ঠ ও স্বাধীন চিন্তা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং মতামত প্রকাশের সংবিধান প্রদত্ত অধিকার প্রয়োগের পথ রুদ্ধ করার মতো ঘটনা ঘটে চলেছে।
একই সঙ্গে সীমান্তে হত্যা, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে হুমকি ও হামলা, এমনকি গণপিটুনির মতো ঘটনা বেড়েছে।
এমএসএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে প্রতিবেদনের এসব তুলে ধরে ক্ষোভ ও উদ্বেগ জানানো হয়েছে।
হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু
মার্চ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। অপরদিকে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের পর দুইজনের কারাগারে মৃত্যুর অভিযোগ পাওয়া গেছে।
নির্যাতনের একপর্যায়ে ভয়ে পালিয়ে যাওয়া অভিযুক্তকে মৃত অবস্থায় ডোবা থেকে উদ্ধার, থানার ভেতরে অন্তঃসত্ত্বার পেটে লাথি মেরে গর্ভপাত ঘটানো, দাবিকৃত টাকা দিতে না পারায় থানার ভেতরে দুই ব্যক্তিকে নির্যাতন ও হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কর্মরত ব্রাদারকে মারধর করা এবং আরেক ঘটনায় এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে নিজ স্ত্রীকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে।
এমএসএফ মনে করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ ও পরবর্তীতে কারা হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুতর ও অগ্রহণযোগ্য। ঘটনাগুলোর তদন্তপূর্বক জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া আবশ্যক।
এমএসএফের সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ মাসে কারা হেফাজতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে মধ্যে ছয়জন কয়েদি ও এক বিদেশি নারীসহ চারজন হাজতি।
কারাগারে অপর্যাপ্ত চিকিৎসার কারণে বন্দিরা যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বন্দি অসুস্থ হলে তাকে কারাগারের বাইরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, নয়তো হাসপাতালে নেয়ার আগেই অধিকাংশ বন্দির মৃত্যু হয়।
এমএসএফ বিশ্বাস করে যে কারাগারের অভ্যন্তরে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির পাশাপাশি হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনাগুলো সঠিকভাবে তদন্ত করা গুরুত্বপূর্ণ।
সংবিধান কী বলছে?
বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না, যাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে’ (৩১ অনুচ্ছেদ)। নবম সংসদে পাস করা ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু (নিবারণ) বিল, ২০১৩ ’-এ সরকারের হেফাজতে থাকা অবস্থায় কারও ওপর নির্যাতন চালানোকে অপরাধ বলে বর্ণনা করে এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির বিধান করা হয়েছে।
২০০৩ সালে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ও ১৬৭ ধারা বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ে এই নিয়ে সুস্পষ্ট বাধার কথা বলা হয়েছিল, ১৩ বছর লেগেছিল এই বিষয়ে সরকারের আপিল নিষ্পত্তি করতে, ২০১৬ সালের মে মাসে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল, ১০ নভেম্বরে পূর্ণ রায় প্রকাশিত হয়, সেখানে ১৬৪ ধারার বিষয়ে আদালতের নির্দেশনায় সুস্পষ্টভাবেই বলা হয়েছিল যে সরকারের হেফাজতে থাকার সময় কারও ওপর নির্যাতন করা যাবে না।
বাংলাদেশের আইন বলছে, ‘হেফাজতে মৃত্যু’ বেআইনি কাজ, অপরাধ। তারপরও এর বিচার হয় না। ২০১৩ সালের আইনে এ পর্যন্ত বিচার হয়েছে একটি।
হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনার বিচার হয় না, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার অভিযোগও করে না। পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা নেওয়ার উদাহরণ বিরল বললেও বাড়িয়ে বলা হয়। কিন্তু অভিযোগ না করেও পরিবারের যেসব অভিজ্ঞতা তা জানলেই বোঝা যায়, কেন কারও পক্ষে অভিযোগ করার সাহস দেখানো সম্ভব নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার
বর্তমান সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রবলভাবে সমালোচিত হওয়ায় এ আইনে মামলার নামে হয়রানি বা অপব্যবহার কিছুটা কমেছে।
গণমাধ্যম ও এমএসএফ কর্তৃক সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী এ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ছয়টি মামলায় দুই আইনজীবী, এক সাংবাদিক, একজন বিরোধীদলীয় নেতার ভাই ও একজন প্রবাসী গ্রেপ্তার হয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে কথিত মানহানিকর কটূক্তির অপরাধে এ মাসে চারটি মামলা হয়েছে।
মাহফিলে দাওয়াত না দিয়ে নাম প্রচার, গালিগালাজ নিয়ে একটি এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অধ্যক্ষ ও শিক্ষক-কর্মচারীদের নিয়ে ফেসবুকে কথিত কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য একটি মামলা হয়েছে।
সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের অধিকার
পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মার্চে অন্তত ৩৫ জন সাংবাদিক নানাভাবে হুমকি, হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
তাদের মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধাপ্রাপ্ত ও আহত হন ১০ সাংবাদিক, ১৫ সাংবাদিক নিরাপত্তা চেয়ে সাধারণ ডায়েরি করেছেন, চারজনকে হুমকি দেয়া হয়েছে, একজনকে আক্রমণ এবং পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতন
প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চে দেশের চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, ঢাকা, ভোলা, পটুয়াখালী ও রাজশাহীতে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নির্যাতনের সাতটি ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রামে শিবমন্দিরে আগুন, ফরিদপুর ও ভোলায় মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, স্বর্ণালংকার চুরি, ঢাকায় ইসকন মন্দিরে ও সাভারে সম্পত্তি দখলের জন্য বাড়িতে হামলা এবং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় রাখাইন সম্প্রদায়ের শ্মশানের জমিতে ঘর উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে ঈশ্বরীপুর এলাকায় ধানের জমিতে পানি না পেয়ে প্রতিবাদ হিসেবে দুই সাঁওতাল কৃষক বিষপানে আত্মহত্যার অভিযোগ উঠেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫৫
আপনার মতামত জানানঃ