প্রায় প্রতিটি বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস যেন বর্তমানে একটি রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ধরনটাও পাল্টে গেছে। পরীক্ষার আগে পড়াশোনা করার চেয়ে তারা বেশি ব্যস্ত ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের খোঁজে।
প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, মিছিল প্রভৃতি অরাজকতা। উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকলেও দুর্নীতিতে শীর্ষে অবস্থান করছি আমরা, যা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত অপমানজনক।
দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, আর্থিক কেলেঙ্কারি এখন আর নতুন কিছু নয়। আশঙ্কার বিষয় হল, বর্তমান প্রজন্ম কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে শিক্ষাজীবনেই দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে দুর্নীতির এক অভিনব পদ্ধতি প্রশ্নপত্র ফাঁস।
প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পাবলিক পরীক্ষায় অপরাধের ঘটনায় করা মামলার বেশির ভাগই প্রমাণ করতে পারছে না রাষ্ট্রপক্ষ। গত ১৩ বছরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে করা ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১টির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ২২ ভাগ। অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ মামলার আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।
ঢাকার সিএমএম আদালতের দৈনন্দিন কার্যতালিকাসহ বিচারসংক্রান্ত নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনা করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। খবর প্রথম আলো
২০০৯ থেকে ২০২১ সাল—এই ১৩ বছরে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় মোট ২০০টি মামলা হয়। এসএসসি, এইচএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি, বিভিন্ন চাকরির নিয়োগ পরীক্ষার (ব্যাংক, বিসিএস ইত্যাদি) প্রশ্নপত্র ফাঁসসহ পরীক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগে এসব মামলা হয়। এগুলোর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৪৫টি মামলার। মাত্র একটি মামলায় এক আসামির পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়েছে।
কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তদন্তে দুর্বলতা, ‘ভুল আইনে’ মামলা ও অভিযোগপত্র দেওয়া, সাক্ষীকে হাজির না করায় আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনটি ১৯৮০ সালের। প্রশ্নপত্র ফাঁস, বইপত্র কিংবা যান্ত্রিক উপায়ে পরীক্ষার্থীকে সহায়তা করা, অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া, ভুয়া সার্টিফিকেট বানানো ও পরীক্ষায় বাধা দেওয়ার মতো অপরাধে এ আইনে মামলা করা হয়। তবে গত কয়েক বছরে ডিজিটাল মাধ্যম (ডিভাইস ও অ্যাপস) ব্যবহার করে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) আইনেও মামলা হয়েছে। এখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হচ্ছে। এ দুটি আইনে করা মামলাগুলো ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও ঢাকার সিএমএম আদালতে বিচারাধীন।
পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে ২০০৯ সালে ঢাকায় দুটি মামলা হয়। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৩৩। এই ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৬টি মামলা হয়েছে ২০১৪ সালে, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৩টি মামলা হয় ২০১৮ সালে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে মামলা হয় ৩টি।
ঢাকার সিএমএম আদালতে নিষ্পত্তি হওয়া ৪৫টি মামলার মধ্যে ৪৪টিতেই কোনো আসামির সাজা হয়নি। অর্থাৎ ৯৮ শতাংশ মামলাই টেকেনি।
এসব মামলার মধ্যে ১৮টির আসামিরা অভিযোগ গঠনের আগেই অব্যাহতি পান। ১৫টিতে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। ১১টিতে আদালত পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণের পর আসামিরা খালাস পান।
নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগের করা মামলা রয়েছে পাঁচটি। পরীক্ষার্থীকে লিখিত কাগজ সরবরাহ এবং মৌখিক বা যান্ত্রিক উপায়ে সহায়তা করার অভিযোগে মামলার সংখ্যা ৩১। প্রকৃত পরীক্ষার্থী না হয়েও পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অপরাধের মামলা রয়েছে ছয়টি। আর ভুয়া সার্টিফিকেট তৈরির অভিযোগের মামলার সংখ্যা ৩।
গত ১৩ বছরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে করা ৪৫টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে মাত্র ১টির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে, শতকরা হিসাবে ২ দশমিক ২২ ভাগ। অর্থাৎ ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ মামলার আসামিরা অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন।
২০১৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ডিজিটাল মাধ্যমের সাহায্য নেওয়ার সময় ধরা পড়েন কে এম রেজওয়ানুল এহসান, ইফরাতুন কাউসার ও ফারহা ফারজানা। এ ঘটনায় করা মামলায় তিন আসামিকে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর খালাস দেন ঢাকার সিএমএম আদালত। রায়ে আদালত বলেন, মাত্র একজন সাক্ষীকে হাজির করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। জব্দ করা আলামতও আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। অভিযোগ প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ।
২০১৮ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে অফিস সহায়ক পদে মৌখিক পরীক্ষা দেওয়ার সময় ধরা পড়েন ‘ভুয়া পরীক্ষার্থী’ আবিদা। এ ঘটনায় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের ৩–ক ধারায় মামলা করা হয়। ২০২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর আসামিকে অব্যাহতি দেন আদালত।
রায়ে বলা হয়, এ ক্ষেত্রে পাবলিক পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধ হয়নি। এটি ছিল চাকরির পরীক্ষা। আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান নেই।
অভিযোগ গঠনের আগেই আসামিরা অব্যাহতি পেয়েছেন, এমন সাতটির মামলা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঘটনা চাকরির পরীক্ষাসংক্রান্ত অপরাধের, কিন্তু মামলা হয় পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনে। এ কারণে চারটি মামলার আসামিরা অব্যাহতি পান। আর যথাযথভাবে মামলার জব্দ তালিকা প্রস্তুত না করার কারণে আরও তিনটি মামলার আসামি অব্যাহতি পেয়েছেন।
ঢাকা মহানগরের প্রধান কৌঁসুলি আবদুল্লাহ আবু বলেন, পাবলিক পরীক্ষা (অপরাধ) আইনের সংজ্ঞায় পড়ে না, এমন অপরাধের মামলা ওই আইনে হয়ে থাকলে তা খতিয়ে দেখা হবে।
আইনটির ১-ঘ ধারায় বলা হয়েছে, ‘“পাবলিক পরীক্ষা” অর্থ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা বোর্ড কর্তৃক অনুষ্ঠিত, পরিচালিত, নিয়ন্ত্রিত বা সংগঠিত হয় বা হতে পারে এরূপ কোনো পরীক্ষা।’ এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, চাকরির পরীক্ষা ‘পাবলিক পরীক্ষা’ নয়।
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের যেসব ব্যর্থতায় আসামিদের সাজা হচ্ছে না, সেসব কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। তাঁর মতে, আইনে ‘পাবলিক পরীক্ষা’র সংজ্ঞার মধ্যে চাকরির নিয়োগ পরীক্ষাসহ এ–সংক্রান্ত অপরাধ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশ দণ্ডবিধি জানে এবং দণ্ডবিধির অপরাধগুলো ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী তদন্ত করা, সাক্ষী জোগাড় করা—সবই তারা জানে। তাঁর মতে, ‘এখন করণীয় হলো নতুন অপরাধটা বিদ্যমান দণ্ডবিধিতে একটা বা দুইটা উপধারার মাধ্যমে যোগ করে দেওয়া। যেমন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধটা দণ্ডবিধির ৪০৫ ধারায় (অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গ) একটা উপধারা হিসেবে যোগ করে দিলেই হয়।’
প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা নতুন নয়। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি দুরারোগ্য ব্যাধির মতো জেঁকে বসেছে। কোনোভাবেই এর হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি প্রেসের কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তাÑঅনেকেই এই চক্রের সঙ্গে জড়িত।
এতোদিন চাকরিসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা এমনকি জেএসসি-প্রাথমিকের প্রশ্নও ছড়িয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। হয় পরীক্ষার আগের রাতে কিংবা পরীক্ষার দিন সকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদৌলতে প্রশ্নপত্র পৌছে যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের হাতে হাতে। চলমান মাধ্যমিক পরীক্ষায়ও প্রশ্নফাঁস প্রমাণের বহু খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বহু উদ্যোগের কথা বলা হলেও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না এটি। প্রশ্নফাঁস যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এতে সবচেয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা।
এ বিষয় শিক্ষাবিদেরা বলছেন, অবিলম্বে প্রশ্নফাঁস বন্ধ করতে না পারলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে পড়বে, মেধাহীন হবে জাতি। তারা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসের কারণে একদিকে যেমন দুর্বল মেধার শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্য দিকে যোগ্য লোক বঞ্চিত হচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত ফল ও চাকরি থেকে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেধাবীরা কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাদের অনেকের নৈতিক স্খলন হয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এদের একটি বড় অংশ হতাশা থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে মাদকে। এই করুণ পরিণতি এখনি ঠেকাতে না পারলে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
তারা বলেন, প্রশ্নফাঁস ঘটনার সঙ্গে আমাদের নৈতিক বিষয়টি জড়িত। সমাজে অনৈতিকতা ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এটাই তার প্রমাণ। এখন প্রশ্নফাঁস হলে আগে মা-বাবাও দৌড়ান ফাঁস হাওয়া প্রশ্ন যোগার করার জন্য। সন্তানও মা-বাবাকে দ্বিধাহীনভাবে বলছে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন যোগার করে দিতে। কারণ প্রশ্ন যোগার করতে না পারলে তার সন্তানও প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে। যে বাবা মা সন্তানকে নৈতিকতা শিক্ষা দিবে সে বাবা মা যদি সন্তানকে অনৈতিক সুবিধা দিতে কাজ করেন তাহলে আমাদের সমাজ নৈতিকতা শিখবে কিভাবে? এই যে চিত্রটা এটা জাতির জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ