ইউক্রেনে সংঘাত চলছেই। দেশটিতে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত থাকায় বিভিন্ন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে। দেশ ছেড়ে লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে গেছে। খাদ্য, পানির তীব্র সংকট তৈরি হয়েছে। যুদ্ধ না থামলে পরিস্থিতি আরও খারাপ আকার ধারণ করতে পারে।
ইতিমধ্যেই যুদ্ধকালীন বাস্তবতায় এক প্রকার অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ইউক্রেনের অর্থনীতি। ধ্বংস হয়ে পড়েছে দেশটির বিভিন্ন অবকাঠামো। বন্ধ হয়ে গিয়েছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সাধারণ নাগরিকরা মৌলিক সেবাগুলোও পাচ্ছে না।
জাতিসংঘের আশঙ্কা, এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী বছরের মধ্যে দেশটির গত দুই দশকের যাবতীয় অগ্রগতি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দারিদ্র্যে পতিত হবে দেশটির ৯০ শতাংশ মানুষ।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বিষয়ক সংস্থা (ইউএনডিপি) সতর্ক করে জানিয়েছে, ইউক্রেনের চলমান সংঘাত যদি থামানো না যায়, তবে এই আশঙ্কা বাস্তবে পরিণত হবে।
ইউএনডিপি’র পরিচালক আচিম স্টেইনার আল জাজিরাকে বলেন, আমরা দেখছি যে, পুরো ইউক্রেন জুড়েই মানুষ তাদের জীবিকা হারিয়েছে।
কিয়েভের প্রশাসন মানুষকে সহায়তার জন্য বেশ কিছু নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে। তবে আয় উপার্জন করতে সক্ষম নয় এমন লাখ লাখ মানুষের দেখাশোনা করার ক্ষমতা কর্তৃপক্ষের জন্য একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে সতর্ক করেন স্টেইনার।
এরই মধ্যে দেশটির অর্থনীতি ১০ শতাংশ সংকোচনের মুখে পড়ে গিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। সংস্থাটিও মনে করছে, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পরিস্থিতি খুব দ্রুত আরো খারাপের দিকে যাবে।
চলমান যুদ্ধ শুধু ইউক্রেন বা রাশিয়া নয়, বিশ্বের অন্যান্য অংশেও ঝুঁকির কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খাদ্যশস্য সরবরাহকারী দেশ ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতির কারণে আফ্রিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও খাদ্যশস্যের সংকটের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
ইউএনডিপির প্রশাসক আখিম স্টেইনার এ প্রসঙ্গে বলেন, আফ্রিকার অন্তত ৪৫টি দেশের এক-তৃতীয়াংশ গম সরবরাহ হতো রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে স্বল্পোন্নত এসব দেশ খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটাতে গিয়ে বিপদে পড়বে।
তিনি বলেন, যদি এ যুদ্ধ চলমান থাকে তাহলে শিগগিরই আমরা দারিদ্র্যের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়ে যেতে দেখব। যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটবে সামগ্রিক অর্থনীতির চরম পতনের মধ্য দিয়ে। শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের ৯০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অথবা দারিদ্র্যের চরম সীমানায় চলে যাবে।
এ পরিস্থিতিতে ইউএনডিপি যুদ্ধবিধ্বস্ত অন্যান্য দেশের মতো ইউক্রেনের পাশেও দাঁড়াতে চায় উল্লেখ করে আখিম স্টেইনার বলেন, অন্যান্য দেশে এ পরিস্থিতিতে যেসব কর্মসূচি সফল হয়েছে সেগুলোই ইউক্রেনে ব্যবহার করা হবে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেনে অর্থনীতির ধসজনিত বিপত্তি ঠেকাতে কিয়েভ সরকারের সঙ্গে কাজ করছে ইউএনডিপি। এর আওতায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে খাদ্য ক্রয়ের জন্য অর্থসহায়তা দেয়ার পাশাপাশি মৌলিক পরিষেবাগুলোর প্রাপ্যতা নিশ্চিতেরও চেষ্টা করা হবে, যাতে সেখানকার নাগরিকদের মধ্যে দেশ ছেড়ে পালানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয়।
ইউক্রেন সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ওলেগ উসতেনকোর বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, চলমান যুদ্ধে আক্রমণে এখন পর্যন্ত দেশটিতে ১০ হাজার কোটি ডলারের অবকাঠামো ধ্বংস হয়েছে। পুরোপুরি বন্ধ পড়েছে ইউক্রেনের ৫০ শতাংশ ব্যবসা।
তার বক্তব্য অনুযায়ী, এভাবে চলতে থাকলে গত ১৮ বছরে দেশটি যে উন্নতি করেছে তা ধ্বংস হতে মাত্র ১২ থেকে ১৮ মাস লাগবে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিসমাপ্তি গোটা বিশ্বের জন্যই মঙ্গলজনক। এ যুদ্ধের ইতি টানতে এরই মধ্যে দুই দেশ কয়েক দফায় আলোচনায় বসেছে। দুপক্ষই বলছে, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন হলেও বর্তমান পরিস্থিতি উন্নতির সুযোগ রয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলমান থাকলেও এখন পর্যন্ত কিয়েভ দখল করতে পারেনি রাশিয়া। সরকার উত্খাতের মতো পরিস্থিতিও এখনো তৈরি হয়নি। আবার সেখানে নতুন করে সৈন্য পাঠাতেও খুব একটা আগ্রহী নয় মস্কো।
আবার ইউক্রেনের পক্ষ থেকেও এখন অনেকটাই রক্ষণাত্মক বক্তব্য আসছে। এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও ন্যাটোতে যোগ না দেয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন। নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে রাশিয়ার উদ্বেগকেও গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটি।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আরবিসি নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি চুক্তির জন্য তারা খুব কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছেন। কিয়েভের সঙ্গে একটা সমঝোতায় পৌঁছার পরিবেশ তৈরি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় পৌঁছার চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও। তার ভাষায়, এখন আলোচনা করার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, সমঝোতার বিষয়টি এখন বাস্তবে রূপ নেয়ার পর্যায়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ধৈর্যের সঙ্গে দুই পক্ষকেই চেষ্টা করতে হবে। একটি চুক্তি যেকোনো যুদ্ধকে থামিয়ে দিতে পারে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬১০
আপনার মতামত জানানঃ