পাকিস্তান এখন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য ধীরে ধীরে নরক হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। অধিকাংশ সময়ই তা প্রকাশ্যে না এলেও মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীরা সংখ্যালঘুদের ওপর কী পরিমাণে অত্যাচার চালাচ্ছে। সংখ্যালঘুরা ভয়ে কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না। তাদের সেখানে কোনো নাগরিক অধিকার নেই। পাকিস্তানী হয়েও তাদের থাকতে হয় অনাগরিকের মতো।
ইমরান খানের সরকার পাকিস্তানে ধর্মীয় সহিংসতা কমাতে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে দেশটিতে এই ইস্যুতে সংঘাত আরও বেড়েছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এএনআই।
প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে হত্যা নতুন কিছু নয়। গত কয়েকবছরে এসব ঘটনা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছে মার্কিন গণমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, ধর্মীয় সহিংসতা বন্ধে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা কার্যকর হয়নি। এমনকি কোনো বাস্তবসম্মত কোনো পদক্ষেপ নিতেও ব্যর্থ হয়েছে তারা।
ইসলামাবাদ ভিত্তিক মানবাধিকার কর্মী তাহিরা আব্দুল্লাহ জানান, রাজনৈতিক উদাসিনতা হলো ধর্ম অবমাননা বিষয়ক আইন অপব্যবহার বন্ধের সবচেয়ে বড় বাধা। ইমরান খানের সরকার ধর্মীয় সহিংসতার হুমকি মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ক্ষেত্রে তার পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা নয়। তবে, পার্লামেন্টে প্রভাবশালী ধর্মীয় দলগুলোর আচরণও কাপুরুষতার পরিচয় দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধর্ম স্বাধীনতা কমিশনের তথ্য মোতাবেক, পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে ধর্মীয় সংঘাত অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধর্ম স্বাধীনতা কমিশনের তথ্য মোতাবেক, পাকিস্তানে ধর্ম অবমাননার নামে ধর্মীয় সংঘাত অন্যান্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি।
পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হওয়ার কারণে তাদের ওপর নানাভাবে বৈষম্য করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতেই। সুন্নি মুসলিম-গরিষ্ঠ পাকিস্তানি সমাজ এই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হিংসা, গণহত্যা, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ কিংবা জোর করে ইসলামে ধর্মান্তর করে চলেছে নির্বিচারে।
ইসলাম ধর্মের মহানবীকে অপমান করলে পাকিস্তানে বাধ্যতামূলকভাবে মুত্যুর সাজা হয়৷ প্রায় ৯৫ শতাংশ মুসলমানের এই দেশে কঠোর ব্লাসফেমি আইন কার্যকর রয়েছে৷ পাকিস্তানে ব্লাসফেমির জন্য যতটা না ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে তারচেয়ে অনেক বেশি এই আইনের বলে সংঘবদ্ধ জনতাকে হত্যা করা হয়েছে৷
পাকিস্তানে এই আইনের সূচনা হয় সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউল হকের অধীনে ১৯৮০ এর দশকে৷ এই আইন অনুযায়ী ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) কে অবমাননা করলে তার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড৷ এছাড়া ইসলাম ধর্ম, পবিত্র কোরআনসহ নির্দিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিদের নিন্দা বা অবমাননায় কারাদণ্ডসহ কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে৷
দেশটির সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে ১৯৪৭ থেকে ধর্ম অবমাননার ঘটনায় এক হাজার ৪১৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে এবং ওই সময় থেকে ২০২১ পর্যন্ত ধর্ম অবমাননার ঘটনায় ১৮ জন নারী এবং ৭১ জন পুরুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন।
তবে, এ ধরনের সব ঘটনায় মামলা না হওয়ায় প্রকৃত সংখ্যা বেশি বলে ধারণা করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ম অবমাননার ৭০ শতাংশেরও বেশি অভিযোগ আসে পাঞ্জাব থেকে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ধর্মবিরোধী এই ব্লাসফেমি আইনটি সাধারণত ধর্মীয় কট্টরপন্থিদের পাশাপাশি সাধারণ বহু পাকিস্তানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়৷
তারা বলছে, সংখ্যালঘুদের দমনে এই আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে৷ অনেক ক্ষেত্রে এমনকি মুসলিমরাও ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে একজন আরেকজনকে ব্লাসফেমি মামলায় ফাঁসিয়ে দিচ্ছেন৷
আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, ব্লাসফেমির অভিযোগ খুবই উদ্বেগজনক৷ কেননা, অভিযুক্ত ব্যক্তি সহিংসতার ঝুঁকিতে পড়ছেন৷ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে ব্লাসফেমি আইনের প্রয়োগ বাড়ছে উল্লেখ করে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার উস্কানিমূলক ঘটনা বন্ধে দেশটির নেতৃত্বের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তারা৷
তারা বলেন, পাকিস্তানের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠদের ধর্মীয় সংবেদনশীলতা রক্ষার লক্ষ্যে অস্পষ্টভাবে প্রণীত ব্লাসফেমি আইনগুলোর পুলিশ এবং বিচার বিভাগ নির্বিচারে প্রয়োগ করছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অনেক দেশেই ‘ব্লাসফেমি’, ‘ধর্মীয় অবমাননা’ এবং ‘ধর্মত্যাগ’ শাস্তিযোগ্য অপরাধ৷ বাস্তবে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক শত্রুতা, জমি নিয়ে বিরোধের ক্ষেত্রেও হাতিয়ার করা হয় এসব আইনকে৷
আরও বলেন, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা প্রতিনিয়ত অবরোধের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। সংবিধান অনুযায়ী সব নাগরিকের সমান অধিকার থাকলেও তা কেবল কাগজে কলমে। হিন্দু, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, আহমদি এমনকি শিয়ারাও দেশটিতে অ-নাগরিক হিসাবে বিবেচিত হয়। তাদের কথা বলার অধিকার নেই। আইনের সুরক্ষার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত।
পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। দেশটির সরকারি হিসেবে পাকিস্তানে বর্তমানে ৭৫ লাখ হিন্দু আছেন, তবে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের হিসেব অনুযায়ী, পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুর সংখ্যা ৯০ লাখ।
সংশ্লিষ্টদের মতে, পাকিস্তান এখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য ধীরে ধীরে নরক হয়ে উঠছে। প্রতিদিনই সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর চলে অকথ্য অত্যাচার। অধিকাংশ সময়ই তা প্রকাশ্যে না এলেও মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা যায় পাকিস্তানে উগ্র মৌলবাদীরা হিন্দুদের ওপর কী পরিমাণে অত্যাচার চালাচ্ছে।
পাকিস্তানের সরকার বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই করেনি। পাকিস্তানের জনসংখ্যার মাত্র ১.৬ শতাংশ হিন্দু। আর প্রায় রোজ তাদের অকথ্য অত্যাচারের শিকার হতে হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০২৪
আপনার মতামত জানানঃ