২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের উপর চালানো নির্মম নির্যাতনকে গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি ব্লিনকেন ওয়াশিংটনের হলোকস্ট জাদুঘরে আজ সোমবারই (২১ মার্চ) আনুষ্ঠানিকভাবে এ ঘোষণা দেবেন।
এর আগে ২০১৮ সালে রোহিঙ্গাদের উপর সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনাকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসেবে অভিহিত করেছিল ওই সময়ের ট্রাম্প প্রশাসন।
মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করার অর্থ এই নয় যে দেশটির সামরিক শাসকদের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তবে ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-নিপীড়ন শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নিষেজ্ঞার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার।
দ্য হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এখন যুক্তরাষ্ট্রও যদি এটিকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করে তবে মিয়ানমার সরকারের ওপর আরও চাপ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। বাইডেন প্রশাসনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপরও এ ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
মানবাধিকার সংগঠন রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনাল এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। সংগঠনটি একটি বিবৃতিতে বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা খুবই অর্থবহ একটি পদক্ষেপ।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইনে দেশটির সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হন কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। তাদের নিধনে চালানো হয় গণহত্যা। জীবন বাঁচাতে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষ আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ওআইসির সহযোগিতায় ২০১৯ সালে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলা করে গাম্বিয়া। ওই বছর মামলার প্রথম দফার শুনানিও হয়। কিন্তু এসব ঘটনার পরও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া থেকে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
রয়টার্স বলছে, রোহিঙ্গা নির্যাতনকে দ্রুত গণহত্যা হিসেবে স্বীকার করার জন্য এ সংশ্লিষ্ট তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করেছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। এতে সহায়তা করেছে অন্য একটি আইনি সংস্থা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় ১৪ মাস পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিয়ে মিয়ানমারে সহিংসতার বিষয়টি নতুন করে পর্যালোচনা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অ্যান্টনি ব্লিংকেন। এর আগে, বিষয়টি স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এটি অত্যন্ত বড় ঘটনা। এর ফলে রোহিঙ্গা এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল দেশগুলোর কাজ অনেক সহজ হবে।’
মার্কিন গণহত্যা আইন অনেক কঠোর এবং এর সূদুরপ্রসারী প্রভাব আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যখন (কোনও দেশের উপর) এর প্রয়োগ হয়, তখন ওই দেশের বিরুদ্ধে গোটা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন একইভাবে কাজ করে। এছাড়া বিভিন্নধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে জারি হয়।’
সংশ্লিষ্ট দেশে মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য সবধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে এবং মিয়ানমারের অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের উপরও একটি চাপ সৃষ্টি হবে।’
কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা জারি হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট দেশে মানবিক সহায়তা ছাড়া অন্য সবধরনের মার্কিন সহায়তা বন্ধ হয়ে যাবে। বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে এবং মিয়ানমারের অন্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের উপরও একটি চাপ সৃষ্টি হবে।’
আগের মার্কিন প্রসাশন রোহিঙ্গা নির্যাতনকে ‘জাতিগত নিধন’ হিসাবে অভিহিত করেছিল, কিন্তু বাইডেন প্রশাসন কেন এটিকে ‘গণহত্যা’ ঘোষণা করতে যাচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটদের কাছে মূল্যবোধের গুরুত্ব অনেক বেশি।’
মার্কিন প্রশাসন যখন কোনও দেশকে গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত করে তখন আন্তর্জাতিক আইনে এর একটি বড় প্রভাব পড়ে। এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, আইসিসি এবং আইসিজে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত দুটি মামলা চলমান আছে এবং স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে এদের প্রভাব পড়বে।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আইসিসি কোর্টে মিয়ানমার জান্তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলমান আছে এবং আশা করা হচ্ছে— প্রমাণ সংগ্রহের পরে দ্রুত তাদের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু হবে। ওই কোর্টে মার্কিন ঘোষণা একটি বড় রেফারেন্স পয়েন্ট হিসেবে কাজ করবে।
অন্যদিকে আইসিজে কোর্টে মিয়ানমার বিরুদ্ধে মামলা চলছে এবং সেখানে এর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে বোঝা যাবে বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের বড় চাওয়া হচ্ছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং গণহত্যা ঘোষনার পরে মিয়ানমারের সঙ্গে দর কষাকষি করতে সরকারের সুবিধা হবে। এ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, বাংলাদেশের চাওয়া-পাওয়া সবচেয়ে ভালো বাংলাদেশই বোঝে। সরকার সরাসরি মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করলে সবচেয়ে ভালো হবে।
ঠিক চার বছর আগে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য মাঠপর্যায়ের চুক্তি সই করেছিল। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে করা ওই চুক্তিতে বলা হয়েছিল, প্রত্যাবাসন শুরু করে ‘সম্ভব হলে তা দুই বছরের মধ্যে’ শেষ করা হবে।
কিন্তু রাখাইনে ফেরার মতো পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় দুই দফা তারিখ চূড়ান্ত করেও রোহিঙ্গাদের সেখানে পাঠানোর চেষ্টা বিফলে গেছে। এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের আদৌ ফেরত পাঠানো যাবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ কিছুদিন ধরে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
মুখে যতই মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের কথা বলা হোক না কেন, আন্তরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব দেশই যে তাদের নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ রোহিঙ্গা গণহত্যার পরও মিয়ানমারের প্রতি বিভিন্ন দেশের অব্যাহত সমর্থন।
ওই দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এবং দেশটিতে মজুত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ তাদের বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
গণহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত একটা রাষ্ট্রের সঙ্গে বৃহৎ দেশগুলোর এ ধরনের ন্যক্কারজনক সমর্থন খুবই হতাশাজনক। কিন্তু এ ধরনের বাস্তবতা কূটনৈতিক তৎপরতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এক বিশেষ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে বলে আমি মনে করি না। দেশ দুটির অবস্থান প্রায় একই। দুটি দেশই মিয়ানমারের সরকারকে সমর্থন এবং প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে এবং দিচ্ছে।
চীন সরাসরিভাবে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসনের অধীনে মিয়ানমার–সংক্রান্ত নতুন নীতি প্রণয়নের যে সম্ভাবনা আশা করা গিয়েছিল, তা ঘটেনি।
সুতরাং সব দিক থেকেই মিয়ানমারে ক্ষমতায় থাকা প্রশাসন একটা সুবিধাজনক অবস্থানের মধ্যেই রয়েছে, অদূর ভবিষ্যতে যা পরিবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বাংলাদেশ চেয়েছিল, বিচ্ছিন্নভাবে না নিয়ে রোহিঙ্গাদের গ্রাম কিংবা নির্দিষ্ট এলাকায় পাঠানো শুরু হোক। এতে রোহিঙ্গারা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে ফেরার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আর মিয়ানমার চেয়েছিল এখন পর্যন্ত যেসব রোহিঙ্গার পরিচয় যাচাই চূড়ান্ত হয়েছে, তাদের নিয়েই শুরু হোক প্রত্যাবাসন।
কিন্তু গত চার বছরেও প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা যেমন এগোয়নি, তেমনি রাখাইনে পরিবেশের এমন কোনো উন্নতি হয়নি, যা রোহিঙ্গাদের আদিনিবাসে ফিরতে উৎসাহিত করে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৯
আপনার মতামত জানানঃ