করোনা আতঙ্কে ভুগছে সারা বিশ্ব। এই মারণ ভাইরাসে প্রতিদিনই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষের আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। মারা যাচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রতিনিয়ত চলছে গবেষণা। পাওয়া যাচ্ছে নতুন নতুন তথ্য।
এবার জানা গেল, লং কোভিডে আক্রান্তদের চিকিৎসায় গাঁজা ব্যবহার কার্যকরী চিকিৎসা।
কোটি কোটি কোভিড আক্রান্তদের মধ্যে দীর্ঘ কোভিডে (লং কোভিড) ভোগেন প্রায় ১০ থেকে ৩০ শতাংশ মানুষ। এর উপসর্গের মধ্যে আছে ক্লান্তি, মাথাব্যথা, শ্বাসকষ্ট, পেশি দুর্বলতা, জ্বর ও জ্ঞানীয় কর্মহীনতা বা ‘মস্তিষ্কের অস্পষ্টতা’। এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। কারও মধ্যে ১২ সপ্তাহের বেশি এ উপসর্গগুলো থাকলে তাকে কোভিডের ‘দীর্ঘ বাহক’ বলা হয়।
যুক্তরাজ্যের এনএইচএস রিসার্চ ইথিকস কমিটি ও মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথকেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি সংস্থা গত মাসের শুরুতে ঘোষণা দেয়, লং কোভিডের জটিলতায় ভোগা রোগীদের চিকিৎসায় তারা গাঁজার ব্যবহার করতে যাচ্ছে। ওষুধ পরামর্শক কমিটিসংক্রান্ত বেসরকারি সংস্থা ড্রাগ সায়েন্সের করা গবেষণাটি ছয় মাস চলবে এবং ৩০ জন রোগীর ওপর এ পরীক্ষা চালানো হবে।
ট্রায়ালে প্রত্যেক অংশগ্রহণকারীকে একটি নন-সাইকোঅ্যাকটিভ গাঁজা তেলের ওষুধের দৈনিক ডোজ নির্ধারণ করে দেয়া হবে, যা মেডিকাবিলিস নামে পরিচিত। এটি তৈরি করেছে বিওডি অস্ট্রেলিয়া নামের একটি প্রতিষ্ঠান, তারা এ গবেষণাটিও পরিচালনা করছে। অংশগ্রহণকারীদের প্রতিদিন নিজেদের অবস্থা জানাতে হবে, স্বীকৃত দীর্ঘ কোভিড উপসর্গগুলোর মূল্যায়ন করতে হবে। আর চিকিৎসার কার্যকারিতা নির্ধারণে গবেষকরা সেসব ডেটা বিশ্লেষণ করবেন। ফল সন্তোষজনক হলে গবেষণাকে দৈবচয়ন ভিত্তিতে একটি বড় আকারের ট্রায়ালে পরিণত করা হবে। এই ট্রায়ালে যুক্তরাজ্যের অনেক রোগীকে যুক্ত করা হবে।
ড্রাগ সায়েন্সের প্রধান নির্বাহী ডেভিড ব্যাডকক বলেন, ‘লং কোভিড নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে এবং সেটা খুব দ্রুত করতে হবে। গবেষণার মাধ্যমে আমরা সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতিটি বের করতে পারব। এতে গাঁজার মতো ওষুধগুলোর কার্যকারিতাও পর্যালোচনা করা হবে।
যুক্তরাজ্যে ২০১৯ সাল থেকে গাঁজা বৈধ। এর সম্বন্ধে এখনও মানুষের পরিষ্কার ধারণা নেই এবং চিকিৎসকেরা এটি খুব বেশি ব্যবহারের পরামর্শ দেন না।’
গত বছরের এপ্রিলে বায়োমলিকিউলার স্ট্রাকচার অ্যান্ড ডাইনামিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, গাঁজায় থাকা ক্যানাবিনয়েড (সিবিডি) ও ক্যানাবিভারিন (সিভিএন) কোভিড-পরবর্তী জটিলতার চিকিৎসার অংশ হতে পারে। এর পরই বিজ্ঞানীরা গাঁজাকে কোভিড-পরবর্তী চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ অরেগন ও ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগোর দুটি গবেষণায় দেখা যায়, গাঁজায় বিদ্যমান অ্যাসিড মানবদেহে কোভিড বা সার্স কোভ টু রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের সংক্রমণে বাধা দিতে পারে। তবে পরীক্ষা দুটির কোনোটি মানুষের ওপর করা হয়নি।
অবশ্য এর মানে আবার এটা নয় যে গাঁজা খেলেই কেউ কোভিড থেকে সেরে উঠবেন বা তার কোভিড হবে না। গত বছরের জুনে বিজ্ঞানভিত্তিক পত্রিকা সাইকোলজি টুডেতে প্রকাশিত এক গবেষণায় লেখা হয়েছে, ‘ক্যানাবিনয়েডগুলোর কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য আরও অনেক গবেষণা প্রয়োজন।’
মেডিকাবিলিসের পাশাপাশি গাঁজাভিত্তিক আরও কিছু ওষুধ নিয়ে গবেষণা চলছে।
গত বছরের নভেম্বরে ব্রাজিলের সাও পাওলো ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলের হার্ট ইনস্টিটিউট, ইনকোর ঘোষণা দেয়, তারা গাঁজা কোম্পানি ভার্ডেমেড উৎপাদিত একটি ফার্মাসিউটিক্যাল-গ্রেড সিবিডি নির্যাস ব্যবহার করে লং কোভিডের চিকিৎসার গবেষণা পরিচালনা করবে।
গাঁজায় বিদ্যমান অ্যাসিড মানবদেহে কোভিড বা সার্স কোভ টু রোগের জন্য দায়ী ভাইরাসের সংক্রমণে বাধা দিতে পারে।
ব্রাজিলের গবেষকরা দেখার চেষ্টা করছেন, দীর্ঘদিন ধরে কোভিডে আক্রান্তদের জীবনমানে গাঁজার তৈরি ওষুধটি উন্নতি ঘটাতে পারে কি না আগামী এপ্রিলের মধ্যে তারা একটি উত্তর পেয়ে যাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
গবেষণা দলটির প্রধান এদিমার বোক্কি ল্যাটিন অ্যামেরিকান বিজনেস স্টোরিজকে বলেন, ‘মহামারিসংক্রান্ত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রস্তাব করা হয়েছে, লং কোভিড উপসর্গগুলো পরবর্তী জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ঘটাতে যাচ্ছে। আমাদের গবেষণাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এতে আগে কখনোই সিবিডির কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা হয়নি।’
ইংল্যান্ডের শেফিল্ডের নিউরোহ্যাবিলিটেশন কনসালটেন্ট এলিজাবেথ আইভসনও বোক্কির সঙ্গে একমত। তিনি বলেন, ‘লং কোভিডের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবে ভুগতে থাকা অনেক রোগী এখন দেখা যাচ্ছে।’
কানাডার লেথব্রিজ ইউনিভার্সিটি বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, গাঁজার মধ্যে শক্তিশালী স্ট্রেইন খুঁজে পেয়েছেন, যা করোনাভাইরাস প্রতিরোধ এবং কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে।
গবেষকদের মতে, এই স্ট্রেইনগুলো এসিইটু পাথগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে, যা ভাইরাসটি মানুষের শরীরে প্রবেশদ্বার হিসেবে ব্যবহার করে থাকে।
সিটিভি নিউজকে এ গবেষণা প্রকল্পের অন্যতম গবেষক ওলগা কোভালচুক জানান, ‘এ ফলাফলে আমরা প্রথমে সম্পূর্ণ হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম এবং এরপর আমরা সত্যিই খুশি হয়েছিলাম।’
গবেষকরা জানিয়েছেন, গাঁজা ভাইরাসের দেহে প্রবেশের পয়েন্টগুলো ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমাতে পারে। ক্যালগারি হেরাল্ডকে কোভালচুক বলেন, ‘সুতরাং, আপনি ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই করার আরো সুযোগ পান। আমাদের এই গবেষণার ফলাফল বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে- এমন খুব বেশি ওষুধ নেই যেগুলো সংক্রমণটি ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ হ্রাস করার সম্ভাবনা রাখে।’
গবেষকরা স্বীকার করেছেন যে এক্ষেত্রে আরো গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবে তারা এটাও বলেছেন, করোনা প্রতিরোধক হিসেবে গাঁজা মাউথওয়াশ এবং গার্গল প্রোডাক্ট হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় গাঁজার প্রভাব বিশ্লেষণে পরবর্তী গবেষণাগুলোর জন্য এই গবেষণার ফলাফল গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন।
গবেষকদের মতে, বর্তমানের ভয়াবহ এবং দ্রুত বিকশিত মহামারির পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতিটি সম্ভাব্য চিকিত্সার সুযোগ বিবেচনা করতে হবে।’
এদিকে বাংলাদেশে গাঁজা অবৈধ হলেও অন্যান্য সময়ের চেয়ে করোনা সংকটে এর চাহিদা বেড়েছে অনেক। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে রাজধানীতে গাঁজা এসেছে প্রচুর। যদিও অন্যান্য সময়ের তুলনায় দাম বেশি ছিল।
সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, করোনাকালীন সংকটে তরুণদের মাঝে বিষণ্ণতা ও হতাশা কাজ করেছিল বেশি। যার ফলে অন্যান্য মাদকের তুলনায় গাঁজা সেবনে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এছাড়া করোনার সময়ে গাঁজায় রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে জানতে পেরে গাঁজার দিকে তরুণরা ঝুঁকে পড়ে। এমনকি কিছু ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান গাঁজা থেকে করোনা ভ্যাকসিন তৈরীর অনুমোদন চাইলে তরুণদের মাঝে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া গাঁজা বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবেও এই সময় প্রচার হতে থাকে। ফলে অন্যান্য মাদক বা পানীয়ের তুলনায় তরুণদের মাঝে গাঁজা সেবনের চাহিদা তৈরী হয়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১৩
আপনার মতামত জানানঃ