বদলে যাচ্ছে সাক্ষ্য আইন। দেড়শ বছরের পুরনো এই আইনের বেশ কয়েকটি ধারায় সংশোধনী আনতে যাচ্ছে সরকার। এই সংশোধনী চূড়ান্ত হলে ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে ধারণকৃত ছবি, ভিডিও, অডিও রেকর্ডিং মামলায় সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ থাকবে।
ডিজিটালি সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে এ সংক্রান্ত আগের আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে আজ সোমবার মন্ত্রিসভা বৈঠকে ‘এভিডেন্স অ্যাক্টের’ সংশোধিত খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
সভা শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, করোনার পর থেকে ডিজিটালি মামলা-মোকদ্দমা করা হয়। আইন অনুযায়ী ডিজিটালি এভিডেন্স গ্রহণ করা হতো না। আইন সংশোধন হলে ডিজিটাল এভিডেন্স গ্রহণ করা হবে। ডিজিটাল সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হবে।
তিনি বলেন, গত কোভিডের পর থেকে অনলাইনে মামলা মোকদ্দমা চলছিল। এর ফলে সাক্ষী-প্রমাণ সবই অনলাইনে আসছিল। কিন্তু আমাদের এভিডেন্স অ্যাক্টে আবার এ রকম ডিজিটাল এভিডেন্সের সরাসরি কোনো বিধান ছিল না। কেউ যদি মামলায় হেরে যেত, সে যদি আবার আপিল করে উপরের কোর্টে, সেক্ষেত্রে আইনি কিছু জটিলতা হওয়ার সুযোগ ছিল। এটা অনেকদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। এজন্য তারা এটা নিয়ে এসেছেন। এখন থেকে ডিজিটাল যে এভিডেন্স, সেগুলোও গ্রহণ করা হবে।
সচিব বলেন, কেউ যাতে ভুয়া বা জাল সাক্ষ্যপ্রমাণ ডিজিটাল মাধ্যমে হাজির করতে না পারে, আদালত যদি মনে করে যে কোথাও আপত্তিজনক কিছু আছে, অথবা কেউ যদি আপত্তি তোলে, তাহলে ওই সাক্ষ্য-প্রমাণের ফরেনসিক পরীক্ষা করা যাবে।
‘এটা করলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে। কেউ একটা ম্যানুপুলেটেড এভিডেন্স দিলো, এটা কিন্তু বাঁচার কোনো উপায় নাই। কারণ ফরেনসিক করলেই ধরা পরে যাবে। বিশেষ করে ডকুমেন্টের ফরেনসিক কিন্তু দুই চার মিনিটেই করা যায়।
‘একটু সময় লাগে ভিডিওর ক্ষেত্রে, তাও খুব বেশি সময় লাগে না। আমাদের পর্যাপ্ত ল্যাবরেটরি আছে দেশে। … খুব হাই টেকনোলজি আছে। এগুলো বিভিন্ন জায়গায় সরকার সুবিধামতো ছড়িয়ে দিয়ে… যে ডিজিটাল সাক্ষ্য উপস্থাপন করা হবে সেগুলো যদি কোর্ট বা কোনো পক্ষ মনে করে আপত্তি আছে, তাহলে ফরেনসিক করে নেবে’।
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, ‘টুইস্ট করার কোনো উপায় নেই। কেউ যদি টুইস্ট করে, তাহলে আমাদের দণ্ডবিধির ২১১ ধারায় মিথ্যা সাক্ষ্যের বিষয় আছে আর ডিজিটাল অ্যাক্টেরও ৫৭ ধারা আছে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে’।
সোমবার ওই খসড়া নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটা খুব ট্রিকি জিনিস, এ জন্য কেবিনেট বলেছে, আবারও আমাদের কাছে নিয়ে আসুক, আমরা দেখে দেব’।
‘এটা করলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে যাবে। কেউ একটা ম্যানুপুলেটেড এভিডেন্স দিলো, এটা কিন্তু বাঁচার কোনো উপায় নাই। কারণ ফরেনসিক করলেই ধরা পরে যাবে। বিশেষ করে ডকুমেন্টের ফরেনসিক কিন্তু দুই চার মিনিটেই করা যায়।
প্রসঙ্গত, ট্রাইব্যুনাল ও আদালতে মামলার বিচার পরিচালনায় কীভাবে একজন সাক্ষীর কাছ থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ করা অথবা কি পদ্ধতিতে তা গ্রহণ করা হবে, কোনটি সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণীয় বা গ্রহণীয় নয় তা উল্লেখ রয়েছে সাক্ষ্য আইনে। ১৮৭২ সালে প্রণীত এই আইনে মূলত দুই ধরনের সাক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। যা মৌখিক ও দালিলিক সাক্ষ্য হিসাবে পরিচিত। কিন্তু সেখানে ডিজিটাল রেকর্ডকে সাক্ষ্য হিসাবে অন্তর্ভূক্তির কথা বলা নাই। তবে সাক্ষ্য আইন ছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুত বিচার) আইন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে দায়েরকৃত মামলায় ডিজিাটাল ডিভাইসের মাধ্যমে গৃহীত অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্র সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এখন সাক্ষ্য আইন সংশোধনের প্রাথমিক খসড়ায় ‘ডিজিটাল ডিভাইস’ বলতে কোনো ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল, ম্যাগনেটিক, অপটিক্যাল বা তথ্য প্রক্রিয়াকরণ যন্ত্র বা সিস্টেমকে বোঝানো হয়েছে। সংঘটিত অপরাধের অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্র এসব যন্ত্র ও সিস্টেমের মাধ্যমে রেকর্ড করে তা মামলায় সাক্ষ্য হিসাবে উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।
১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের দুটি ধারায় ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মামলায় বাদীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলার যে সুযোগ রয়েছে, সংশোধনে সেখানেও পরিবর্তন আসছে বলে জানিয়েছেন আনোয়ারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ‘ভিকটিমকে জেরা করার ক্ষেত্রে শালীনতা বজায় রাখতে হবে। কোন জাতীয় প্রশ্ন প্রয়োজন সেটা কোর্ট ঠিক করে দেবে’।
সাক্ষ্য আইনের ১৫৫(৪) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যখন বলাৎকার কিংবা শ্লীলতাহানির চেষ্টার অভিযোগে ফৌজদারিতে সোপর্দ হন, তখন দেখানো যেতে পারে যে অভিযোগকারিনী সাধারণভাবে দুশ্চরিত্রা।
আর ১৪৬ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, তাহার চরিত্রের প্রতি আঘাত করে তার বিশ্বাস যোগ্যতা সম্পর্কে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করা যায়, যদিও এ রূপ প্রশ্নের উত্তরের দ্বারা সে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কোনো অপরাধের সহিত জড়িত হতে পারে, কিংবা সে দণ্ডলাভের যোগ্য সাব্যস্ত হতে পারে, অথবা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাহার দণ্ডলাভের যোগ্য সাব্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তথাপি অনুরূপ প্রশ্ন করা যাবে।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা দীর্ঘ দিন ধরে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এই ঔপনিবেশিক আইনটি সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন।
ডিজিটাল সাক্ষ্য দেওয়ার ব্যাপারে আইন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের আদালতগুলোতে মামলা জট বেড়েই চলেছে। এই জট কমাতে বিচার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন দরকার। শুধু বিচার ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করলেই হবে না পুরনো আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতে হবে।’
তারা বলেন, ‘সাক্ষ্য আইন সংশোধন করে সেখানে ডিজিটাল রেকর্ডকে এভিডেন্স হিসাবে গ্রহণের সুযোগ রাখা হচ্ছে। এটা করা হলেই যেকোনো অপরাধের ঘটনায় ডিজিটাল রেকর্ড বিশেষ করে অডিও, ভিডিও ও স্থিরচিত্র সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে দ্রুত বিচার শেষ করা সম্ভব হবে। শুধু দ্রুত বিচারই নয় তখন মৌখিক সাক্ষ্যের ওপর নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসবে। একইসঙ্গে ঘটনার সঠিক বিবরণ সহজেই আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব হবে।’
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের অধিকাংশ ফৌজদারি মামলা চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং দায়রা জজ আদালতসমূহে বিচারাধীন। এসব আদালতে বিচারাধীন অনেক মামলায় সাক্ষ্য হিসাবে ডিজিটাল রেকর্ড থাকলেও তা সাক্ষ্য হিসাবে গ্রহণের সুযোগ বিচারকদের নেই। ফলে মৌখিক সাক্ষীর ওপর অনেকটাই নির্ভর করতে হচ্ছে। কিন্তু মৌখিক সাক্ষীর গরহাজিরার কারণে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে মামলা। বাড়ে মামলার জট। হতাশ হয় বিচারপ্রার্থীরা। এই মামলা জট ও বিচারপ্রার্থীদের যাতে হতাশা দূর হয় সেই লক্ষ্যে সরকার ১৪৯ বছরের পুরনো সাক্ষ্য আইনে সংশোধনী এনে ডিজিটাল রেকর্ডকে সাক্ষ্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করছে, যা প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৯৪০
আপনার মতামত জানানঃ