আসন্ন ঈদকে কেন্দ্র করে ঝুঁকি এড়াতে ডিজিটাল লেনদেন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। গত তিন দিনেই এটিএম, পিওএস, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এবং বাংলা কিউআর ব্যবহার করে ২ হাজার ৭১৮ কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত ২৮ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত এটিএম কার্ডের মাধ্যমে ৭ লাখ ৫২ হাজার ৫৭২টি লেনদেন হয়েছে। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ৬৬২ কোটি ১২ লাখ ১১ হাজার ১২৪ টাকা। একই সময়ে পিওএস মেশিনে ১ লাখ ৭১ হাজার ১৩৪টি লেনদেন হয়। এসব লেনদেনে অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৫ কোটি ১৩ লাখ ৬১ হাজার ৯৪৯ টাকা।
এ সময় ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের আওতায় ৪ লাখ ২৭১টি লেনদেন হয়। লেনদেনের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৯৭৭ কোটি ৬৮ লাখ ৯২ হাজার ২০১ টাকা। এ ছাড়া বাংলা কিউআরের ৩৩ হাজার ৫১২টি লেনদেন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ফ্যাশন হাউসগুলোতে ডিজিটাল পেমেন্টের সুযোগ রয়েছে অনেক দিন ধরেই। ঈদের বাজারে এসে ক্রেতাদের একটি বড় অংশ নগদ টাকার বদলে দাম চুকাচ্ছেন কার্ডে বা এমএফএসের মাধ্যমে। আর ফ্যাশন হাউসগুলোর আউটলেটগুলোতে ঈদের সময় মোট লেনদেনের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশই হয়েছে ডিজিটাল লেনদেন।
নিয়মিত ক্রেডিট কার্ডে কেনাকাটা করছেন মতিঝিল এলাকার ব্যাংক কর্মকর্তা জাকির মিয়া। ঈদ উপলক্ষে কর্ণফুলী শপিং মলে কেনাকাটা করতে এসেছেন। তিনি জানান, ‘জামা-জুতাসহ অন্যান্য পণ্য কেনার ক্ষেত্রে নগদ টাকার চেয়ে কার্ডে পে করাই সুবিধাজনক। আবার ডিজিটাল পেমেন্টে কিছু না কিছু অফার থাকে। সে কারণে সুপার শপগুলোতে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও আমি নিয়মিত বিভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্টের সাহায্য নিই। এখন চায়ের দোকান ও কাঁচাবাজারেই নগদ টাকার লেনদেন বেশি।’
ডিজিটাল লেনদেনের সার্বিক অগ্রগতির পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় জানা যায়, ব্যক্তিপর্যায়ে ডিজিটাল পরিশোধের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এখন মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস)। গত জানুয়ারি মাসে এ মাধ্যমে ১ লাখ ২৯ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। বর্তমানে ২১ কোটি ৯১ লাখের বেশি এমএফএস হিসাব রয়েছে।
ঝুঁকি
অনলাইনে মেয়েদের পোশাকের ব্যবসা করেন কাকলী তানভীর। ব্যবসায়িক ও নিজস্ব কেনাকাটায় নগদ অর্থের ব্যবহার বন্ধ করে একাধিক ব্যাংকের ক্রেডিট কিংবা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করছেন দীর্ঘদিন ধরেই।
বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “জালিয়াতির নিত্য নতুন যেসব পন্থার কথা শুনি মাঝে মধ্যে, তাতে করে এটিএম বুথে ঢুকলে ভয় লাগে”।
“একবার কার্ড নিয়ে সমস্যা হলে বা কেউ জালিয়াতি করে টাকা সরালে তার প্রতিকার নিয়েই উদ্বেগ লাগে। আর ঈদের সময় বা এ ধরণের লম্বা ছুটিতে তো পুরোপুরি কার্ড আর এটিএম বুথ নির্ভর থাকি। তাই ভয় লাগে আরও বেশি”।
জবাবে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “টাকা নিয়ে গ্রাহকের উদ্বেগের কিছু নেই। ব্যাংক বা বুথ থেকে টাকা গেলে সেটি গ্রাহক ফেরত পাবেই। গ্রাহক সবসময় সুরক্ষিত। আইন অনুযায়ী তার টাকা আমি তাকে ফেরত দিতে বাধ্য”।
তিনি বলেন এখন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসে অপরাধীরা ইন্টারনেট আর কম্পিউটারের মাধ্যমে চুরি করছে। যত বেশি আধুনিক প্রযুক্তি আসছে অপরাধীরাও তেমন পন্থা বের করার চেষ্টা করছে।
“এ কারণেই আমাদের আসলে এক পা এগিয়ে থাকতে হবে। ফায়ারওয়াল, সফটওয়্যার এসব বিষয়ে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করছি। আগে ব্যাংকে শুধু আইটি বিভাগ ছিলো এখন আইটি সিকিউরিটি বিভাগ হয়েছে এবং তার ব্যাপ্তি অনেক বেড়েছে”।
তিনি বলেন চ্যালেঞ্জ যেমন আসছে তেমনি এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যাংকগুলোও সক্ষমতা অর্জন করছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
আবার দেশে তুলনামূলক নতুন কার্যক্রম শুরু করা ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি- এনআরবি ব্যাংকের চীফ অপারেটিং অফিসার ইমরান আহমেদ বলছেন প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি বুথ ও কার্ডের বিপরীতে লেনদেনকে সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের আওতায় এনেছেন তারা।
“কার্ড নিয়ে আমরা বেশি উদ্বিগ্ন থাকি। কারণ দেখা গেছে কার্ড হোল্ডার ঢাকায় আর লেনদেন হচ্ছে ভেনিজুয়েলায়। বা ই-কমার্সে পেমেন্টের ক্ষেত্রে জালিয়াতির সুযোগ থাকে। আন্তর্জাতিক জালিয়াত চক্র এগুলো করে। এজন্য টেকনিক্যাল যা করার দরকার সেটি করা হয়েছে”।
তিনি বলেন জালিয়াতরা নিত্য নতুন পন্থা বের করছে তাই আমরাও সিকিউরিটি ভেন্ডরদের সাথে একযোগে কাজ করছি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ কম্পিউটার ভিত্তিক, বুথ ও গ্রাহকদের দেয়া কার্ডের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।
এজন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও বুথে জ্যামারের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টা বুথ ও লেনদেনগুলো সেন্টার সিকিউরিটি সিস্টেম ও কল সেন্টার থেকে মনিটর করা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত নতুন এই ব্যাংকটির নিজস্ব এটিএম বুথ ৪৩টি হলেও ব্যাংকটির গ্রাহকরা দেশের বিদ্যমান সব ব্যাংকের যে হাজার হাজার এটিএম বুথ আছে সেখানে এনআরবির কার্ড দিয়েই টাকা উত্তোলন করতে পারেন।
তাহলে উদ্বেগ কেনো ?
২০১৬ সালে বেসরকারি ইস্টার্ন ব্যাংক, সিটি ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চারটি এটিএম বুথে গ্রাহকের কার্ডের তথ্য-উপাত্ত চুরি করে এটিএম থেকে অর্থ তোলার ঘটনা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলো।
তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে এসব তথ্য চুরি করা হয়েছে। ঐ সময়ের মধ্যে ঐ চারটি বুথে ১২০০ কার্ডে লেনদেন হয়েছে।
তবে তথ্য চুরি ও কার্ড ক্লোন হয়েছে ৩৬ টির মতো কার্ডে এবং এভাবে প্রায় ২০ লাখের মতো অর্থ চুরির ঘটনা ঘটেছিলো।
আর ওই ঘটনাতেও উঠে এসেছিলো কয়েকজন বিদেশী নাগরিকের নাম। এর আগে বনানীর একটি সুপার শপে ডেবিট কার্ডে গ্রাহকরা বিল দেয়ার পর চারটি ব্যাংকের কার্ড জালিয়াতি হয়ে টাকা উত্তোলনের ঘটনা ঘটেছিলো।
এসব কারণেই কার্ড ও এটিএম বুথ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ার প্রেক্ষাপটে ব্যাংকগুলোকে সতর্ক করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও।
কিন্তু এবার ঘটেছে আরও অভিনব ঘটনা। গত শুক্রবার রাতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি বুথ থেকে জালিয়াতি করে অর্থ তুলে নিলেও তার রেকর্ড পাওয়া যায়নি ব্যাংকের সার্ভারে কিংবা কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকেও টাকা যায়নি।
অর্থাৎ টাকাটা সরাসরি এটিএম মেশিন থেকে বের করে নিয়েছে এবং কর্মকর্তারা বলছেন এখানে এক ধরণের কার্ড ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলোর মেশিনে দিয়ে সরাসরি অর্থ বের করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ আটক করে ইউক্রেনের পাঁচ নাগরিককে।
আপনার মতামত জানানঃ