বিশ্বের ৮৫ কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। দুই যুগ আগে মৃত্যুর কারণ হিসেবে কিডনি রোগ ছিল ২৭তম স্থানে। বর্তমানে সপ্তম। ২০৪০ সালে আসবে পঞ্চম স্থানে। বিশ্বের প্রতি ১০ জনে ১ জন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। বিশ্বে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রতিবছর আকস্মিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। এর ৮৫ শতাংশ আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে।
উন্নত দেশে কিডনি বিকলের চিকিৎসা করতে গিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ২০১৯ সালে আমেরিকার শুধু ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন ব্যয় হয়েছে ৫৭ বিলিয়ন ডলার, যা প্রায় আমাদের জাতীয় বাজেটের সমান।
আকস্মিক কিডনি রোগের প্রধান কারণ—ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, বিভিন্ন ধরনের ক্ষত ইত্যাদি। এখন বিশ্বে ২৪ লাখ মানুষ বেঁচে আছে কিডনি সংযোজন ও ডায়ালাইসিসের মাধ্যমে। ২০৩০ সালে এটা প্রায় দ্বিগুণ হবে।
প্রতিবছর বিশ্বে কিডনি রোগে ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এর অধিকাংশই প্রায় ১০০টি নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মানুষ। উন্নত দেশে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০৪০ সালে ৫০ লাখের বেশি রোগী চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। এই রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। বাংলাদেশে দুই কোটির বেশি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকল হয়ে ঘণ্টায় পাঁচজন মারা যায়। কিডনির শেষ চিকিৎসা কিডনি সংযোজন ও ডায়ালাইসিস। এটা এত ব্যয়বহুল যে আমাদের মতো দেশের মানুষের পক্ষে এই চিকিৎসা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য।
কিডনি রোগের একটা ভীষণ খারাপ দিক হলো, প্রাথমিক অবস্থায় বোঝা যায় না। এটা হৃদরোগসহ অন্যান্য রোগ বাড়িয়ে দেয়।
শিশুদের কিডনি সমস্যা
জনসংখ্যার ৪২ ভাগ শিশু। তাদের কিডনি রোগ ভিন্ন প্রকৃতির। কোনো কোনো শিশু ত্রুটি নিয়ে জন্ম নেয়। অনেক শিশু অকার্যকর টিস্যু নিয়ে জন্ম নেয়। এসব কারণে শিশুর কিডনি বিকল হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওষুধ খাওয়া, পানিশূন্যতার বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরি।
সব ক্ষেত্রে কিডনি সমস্যা দ্রুত শনাক্ত হলে প্রায় ৭০ শতাংশ প্রতিরোধ করা যাবে। একবার মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেলে এর চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হলেই চিকিৎসা করতে হবে। এটি বাড়তে দেওয়া যাবে না।
অনেক শিশুর হাইপার টেনশন আছে। তাদের রক্তচাপ পরীক্ষা করতে হবে। ডায়ালাইসিস একটা ব্যয়বহুল ব্যবস্থা। ঢাকাসহ অনেক জেলায় এ ব্যবস্থা আছে।
কিডনি সংযোজন দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা। খরচ চার থেকে ছয় লাখ টাকা। আমাদের কিডনি সংযোজনের মান আন্তর্জাতিক মানের। ১৯৮৬ সালে আমাদের দেশে প্রথম কিডনি সংযোজন করা হয়।
গ্রামের ৮ শতাংশ ও শহরের ২০ শতাংশ শিশু মোটা। তাদের অনেকের উচ্চ রক্তচাপ আছে। অনেকে অ্যালবুমিন যাচ্ছে কিন্তু তারা সেটা জানে না। শিশুদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।
বাংলাদেশের পরিস্থিতি
২০১০ সালে বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬ শতাংশ। বর্তমানে এটা ২০ শতাংশ। ২০১০ সালে ডায়াবেটিস রোগী ছিল ১০ লাখ। ২০২০ সালে এটা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখে। উচ্চ রক্তচাপের রোগী ২০১০ সালে ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ। বর্তমানে এটা ২ কোটির ওপরে।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, ৪০ শতাংশ রোগী জানে না যে তাদের ডায়াবেটিস আছে। ৬০ ভাগ রোগী জানে না যে তাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে। আবার মাত্র ২০ থেকে ১৫ ভাগ রোগীর ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে, ৮০ ভাগের তেমন নিয়ন্ত্রণ নেই। আবার মাত্র ২৫ শতাংশ রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বিশ্বের নতুন গাইডলাইন অনুসারে যদি কিডনি রোগ থাকে, তাহলে ব্লাড প্রেশার রাখতে হবে ১২০ বাই ৮০–এর নিচে। আমার মতে, কিডনি রোগ ভয়াবহ নয়। দেশে ২ কোটি কিডনি রোগীর মধ্যে মাত্র দশমিক ৫ শতাংশের কিডনি ফেইলিওর হয়।
দেশে ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটা কমিউনিটি ক্লিনিক। এখানকার স্বাস্থ্যকর্মীদের একটু প্রশিক্ষণ দিলে কীভাবে উচ্চতা মাপতে হবে, ওজন কত হবে, ডায়াবেটিস আছে কি না, রক্তচাপ ১২০ বাই ৮০ ঠিক আছে কি না—এসব তারা দেখে লিখে রাখতে পারেন। কারও ইউরিনের অ্যালবুমিন যায় কি না, প্রোটিন যায় কি না, সেটি দেখতে হবে। এতে খরচ হবে ৩০০ টাকা।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ
যখন কিডনি ধীরে ধীরে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে কিডনি ছাঁকনিগুলো নষ্ট হতে থাকে, তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ (সিকেডি) বলা হয়।
ক্ষয়ের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে সিকেডি কে পাঁচটি ধাপে ভাগ করা হয়; প্রথম ধাপ হলো— আক্রমণ শুরু অন্যদিকে পঞ্চম ধাপ হলো, যখন কিডনির ক্ষমতা ১৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। এক থেকে চতুর্থ নম্বর ধাপের মধ্যে যদি রোগ ধরা পড়ে, তবে চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস ও সুস্থ জীবন ধারা চর্চার মাধ্যমে কিডনি দীর্ঘদিন ভালো রাখা যায়, রোগ সংক্রান্ত জটিলতা ঠেকিয়ে রাখা যায়।
সিকেডির মূল কারণগুলো আমাদের জীবনধারা চর্চা বা লাইফস্টাইলের সঙ্গে লতাপাতার মতো জড়িয়ে আছে, যার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিজের হাতেই। সিকেডি অনেক কারণে হতে পারে। তবে প্রধান কারণ হলো— অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতা, ধূমপান, অলস জীবনযাপন, অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ প্রভৃতি।
অন্যদিকে কিডনি সম্পর্কে সামান্য কিছু জ্ঞানের অভাবে কিডনি বিনষ্ট হয়। যেমন— মোয়া-মুড়ির মতো ব্যাথার ওষুধ খাওয়া, ভেজাল খাদ্যগ্রহণ, বাচ্চাদের গলাব্যথা, খোসপাঁচড়া চিকিৎসায় অবহেলা, জন্মগত কিডনি সমস্যার দিকে মা-বাবা সচেতন না থাকা, অনেক সময় দেখা যায় বাচ্চাদের সামান্য জন্মগত ত্রুটির কারণে পরবর্তী সময় কিডনি বিকল হয়ে যায় অথচ খুব সহজেই বাচ্চাদের এসব ত্রুটি প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত হলে তা চিকিৎসাযোগ্য।
তা ছাড়া কিডনি বিকলের আরও কারণ আছে; যেমন— বংশগত, কিডনিতে পাথর, মূত্রতন্ত্রের সংক্রমণ, প্রস্রাব প্রবাহে বাধাজনিত রোগ, বয়সজনিত কিডনি রোগ।
কীভাবে প্রতিরোধ সম্ভব
আমাদের আশার জায়গা হলো, এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য। কিডনি রোগ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ৫০ শতাংশ ভালো হওয়া সম্ভব।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ধূমপান, স্থূলতা, অলস জীবনযাপন, ব্যায়াম না করা, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যথানাশক ওষুধ বেশি খাওয়া, ডায়রিয়া, বমি, পানিশূন্যতা—এসব সমস্যায় কিডনি রোগ হয়। অথচ এর সবই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, সব পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের কিডনি রোগ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান অর্জন করতে হবে। নীতিনির্ধারকদের কিডনি রোগ সম্পর্কে জেনে সঠিক নীতি প্রণয়ন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এক হিসাবে দেখা গেছে, ৩ জন কিডনি রোগীর জন্য যে ব্যয় হয়, সেটি দিয়ে ১০ হাজার সাধারণ রোগীকে সেবা দেওয়া যায়।
নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করে প্রাথমিক অবস্থায় যদি কিডনির যে কোনো রোগ শনাক্ত করা যায়, তবে কিডনি বিকল আটকে দেওয়া যায়। শুধু রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করেই প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ শনাক্ত করা যেতে পারে। মনে রাখবেন, কিডনির ক্ষমতা ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ বিনষ্ট হওয়ার পূর্বে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। তাই যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছেন, তারা বছরে অন্তত একবার রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করে কিডনির অবস্থা জেনে নিবেন।
কিডনি ভালো রাখার উপায়
১. কায়িক পরিশ্রম, খেলাধূলা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা।
২. উচ্চরক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৩. সুপ্ত উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ পরীক্ষা করা।
৪. স্বাস্থ্যসম্মত খাবার গ্রহণ যাতে প্রতিদিন শাক-সবজি ও ফল থাকে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা।
৫. পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা।
৬. ধূমপান থেকে বিরত থাকা।
৭. ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কোনো ওষুধ সেবন না করা।
৮.অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় অবহেলা পরিহার।
৯. সুশৃঙ্খল জীবনযাপন।
১০. নিয়মিত কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষা করা।
আপনার মতামত জানানঃ