মানবদেহের এমন কোনও অঙ্গ নেই যার ক্ষতি করছে না করোনা। ফুসফুস, লিভার, হৃদপিণ্ড, এমনকি কিডনিকেও ছাড়ছে না করোনা ভাইরাস। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে— অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের এই ক্ষতিটা বোঝা যাচ্ছে করোনা নেগেটিভ হওয়ার সপ্তাহখানেক পর থেকে। এই সমস্যা কারো কারো আরও পরে হয়। অতি সন্তর্পণে কোষের মধ্যে ঢুকে এই ভাইরাস আত্মগোপন করে থাকে। ধীরে ধীরে কোষগুলোর ক্ষতি করতে থাকে। তাই করোনা নেগেটিভ হওয়া মানেই কিন্তু পুরোপুরি রোগমুক্তি নয়।
এমন নীরবেই কিডনির ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে করোনা ভাইরাস। গতকাল বুধবার কিডনি রোগবিষয়ক সাময়িকী দ্য জার্নাল অব দ্য আমেরিকান সোসাইটি অব নেফ্রোলজিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় এমনটি বলা হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, বাড়িতে চিকিৎসা নিয়ে যারা করোনা থেকে সেরে উঠেছেন তাদের রক্ত শোধন করা অঙ্গগুলো ক্ষতি হতে পারে। এতে কোনো ধরনের ব্যথা থাকে না এবং নীরবেই এটি হয়। এমনকি যে সব করোনা রোগীদের মূত্রাশয়ের কোনো সমস্যা নেই তাদেরও শেষ পর্যায়ের কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যদি হাসপাতালে তারা ভর্তি না হয়।
গবেষণায় আরও বলা হয়, প্রতি ১০ হাজারের মধ্যে অতিরিক্ত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ মানুষকে কিডনির ডায়ালাইসিস অথবা প্রতিস্থাপন করতে হচ্ছে। যারা মৃদু থেকে মাঝারি উপসর্গ নিয়ে করোনায় ভুগছেন।
এ নিয়ে গবেষণা দলের প্রধান যুক্তরাষ্ট্রের মিজৌরির ভেটেরেন্স অ্যাফেয়ার্স সেন্ট লুইস হেলথ কেয়ার সিস্টেমের ক্লিনিকাল এপিডেমিওলজি সেন্টারের পরিচালক জিয়াদ আল-আলি বলেন, এটি ছোট সংখ্যা না। এটি সম্ভবত পরবর্তী দশক বা তারও বেশি সময় ধরে আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করবে।
জানা গেছে, আল-আলি এবং তার সহকর্মীরা এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটেরান্স হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকে ডেটা সংগ্রহ করেছেন। এমন করোনার রোগীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে যারা সেরে ওঠার পর রক্তের জমাট বাঁধা, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস এবং হার্ট, লিভার এবং কিডনির ক্ষতি, বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং স্মৃতিশক্তি হ্রাসে ও শ্বাসকষ্টের চিকিৎসা করাতে এসেছেন।
আল-আলির গবেষণায় বলা হচ্ছে, করোনায় যারা হাসপাতালে ভর্তি হয় না তাদের ছয় মাসের মধ্যে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়্যার ২৩ শতাংশ ঝুঁকি বেশি থাকে। এমন অবস্থায় করোনা রোগীদের রক্ত থেকে বর্জ্য এবং বিষাক্ত পদার্থ অপসারণে বাধা তৈরি হয়।
তাই করোনা থেকে সেরে ওঠাদের কিডনির প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল-আলি বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যাটা হচ্ছে গোপনেই কিডনির সমস্যাটি হয়। এখানে না থাকে কোনো উপসর্গ না থাকে কোনো ব্যথা।
করোনায় সংক্রমিত হলে ফুসফুসের মতো কিডনিরও ক্ষতি হতে পারে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ভারতীয় চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘অবশ্যই পারে। রোগ সৃষ্টিকারী ভাইরাসগুলো সব কোষের মাধ্যমে শরীরে ঢুকতে পারে না। দরকার ‘এসিই ২ রিসেপটর’ কোষ। শ্বাসনালী, ফুসফুস, অন্ত্র, হৃদযন্ত্র, কিডনিতে এই ধরনের কোষের পরিমাণ বেশি।’
তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে ফুসফুস এবং শ্বাসনালীর ‘এসিই ২ রিসেপটর’গুলোতে প্রাথমিক সংক্রমণ হয়। পরে জীবাণুটি রক্তের সংস্পর্শে আসে। রক্তের রোগপ্রতিরোধকারী কোষগুলোর মাধ্যমেই জীবাণু সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষুদ্রান্তে পৌঁছে আন্ত্রিকের সমস্যা সৃষ্টি করে। একইসঙ্গে কিডনিতে পৌঁছে তার কোষও নষ্ট করতে থাকে।’
চিন, নিউ ইয়র্ক, ইতালি ও ফ্রান্সে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাদের ৩০ শতাংশেরই কিডনি খারাপ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের নেগেটিভ রিপোর্ট আসলেই যে তারা সুস্থ হয়ে গেছেন, এটা ঠিক নয়। করোনামুক্ত হওয়ার পর দুই থেকে তিন মাস চিকিৎসকদের পর্যবেক্ষণে থাকার উচিত। মূলত নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরও হার্ট, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, ব্রেনসহ শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে। এক্ষেত্রে দেশের এক শ্রেণির ডাক্তার ও রোগীদের অবহেলায় অনেক রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/এসএস/১৪৩৩
আপনার মতামত জানানঃ