ইউক্রেনে পুরোদস্ত্তর সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। রবিবার রুশ বাহিনী টানা ১১ দিনের মতো হামলা অব্যাহত রাখে। ইউক্রেনের বেশ কয়েকটি শহরে বোমা হামলা চলছে। রুশ সেনা হামলা শুরুর পর যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছে শত শত সামরিক-বেসামরিক মানুষ। লাখ লাখ মানুষ এখন বাস্তুচ্যুত। ইউক্রেন ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে সর্বোচ্চ।
এই হামলা ইউক্রেনকে যেমন বিধ্বস্ত করছে তার প্রভাব তেমনি পড়ছে বিশ্বেও। কায়রো থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত খাদ্যের ও জ্বালানির দামে প্রভাব ফেলেছে রাশিয়ার এই আগ্রাসন। এই হামলা বিশ্ব ভূ-রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, জারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান সুভেইন টোর হোলসেথের বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বজুড়ে খাবারের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে এবং দাম বেড়ে যাচ্ছে।
গ্যাস সংকটের কারণে আগে থেকেই চড়া দামে থাকা সারের দাম যুদ্ধে আরও বেড়েছে।
বিশ্বের ৬০টি দেশে ব্যবসা পরিচালনাকারী জারা রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল কিনে থাকে।
‘যুদ্ধের আগে থেকেই আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলাম। কিন্তু এখন সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে,’ তিনি বলেছেন।
বিবিসি সোমবার এক প্রতিবেদনে জানায়, পাইকারি গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ায় আগে থেকেই সারের দাম বেশি ছিল।
তবে পরিস্থিতি আরও কঠিন হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন ইয়ারার প্রধান স্ভেইন টোরে হোলসেথার।
তিনি বিবিসিকে বলেন, প্রতি ঘণ্টাই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। যুদ্ধের আগে থেকেই পরিস্থিতি খারাপ ছিল…তবে এখন সরবরাহের ক্ষেত্রে আরও ব্যাঘাত ঘটছে এবং আমরা উত্তর গোলার্ধের জন্য এই মরসুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশের কাছাকাছি চলে এসেছি। এই সময় প্রচুর পরিমাণে সার ব্যবহার করতে হবে। এই পরিস্থিতি সেই বিষয়ের ওপর প্রভাব ফেলবে।
প্রসঙ্গত, রাশিয়া এবং ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী কৃষি ও খাদ্যের সবচেয়ে বড় উৎপাদনকারী দেশ।
রাশিয়ায় পটাশ এবং ফসফেটের মতো প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়, যা সার তৈরির মূল উপাদান। এসব গাছপালা এবং ফসলের উৎপাদন বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখে।
হলসেথার বলেন, সার ব্যাবহারের ফলে খাদ্যের উৎপাদন বাড়ে। বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা খাদ্য পায়….তাই ফসলের ক্ষেতে সার ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া হলে, [ফলন] ৫০% কমে যাবে।
তিনি বলেন, আমরা কাছে আমরা বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের দিকে যাচ্ছি কি না তা বড় বিষয় নয় – খাদ্য সংকট কতটা বেশি হবে সেটাই মুখ্য বিষয়।
তিনি বলেন, কিয়েভে ইয়ারার অফিসে ইতোমধ্যেই ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হেনেছে। তবে এই হামলায় অফিসের ১১ কর্মীর কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হননি।
এদিকে, চলমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ান সরকার সেদেশের উৎপাদকদের সার রপ্তানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে বলে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে হলসেথার বলেন, ইউরোপীয় খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত সারের প্রায় এক চতুর্থাংশ রাশিয়া থেকে আসে।
জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী খাদ্য উত্পাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মহামারি শুরুর আগেই এই সমস্যাগুলো ছিল। মহামারি এসে সেই সমস্যাকে আরও খারাপের দিকেই নিয়ে গেছে।
এই অবস্থায় ইয়ারা ইন্টারন্যাশনালের প্রধান নির্বাহী যুদ্ধকে ‘বিপর্যয়ের শীর্ষে একটি বিপর্যয়’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। এই যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহ শৃঙ্খলকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে এবং দরিদ্র দেশগুলোতে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।
ইউক্রেনকে ইউরোপের ‘ব্রেডবাস্কেট’ বলা হয়। এই যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। কারণ ২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ইউক্রেনের তৃতীয় সর্বোচ্চ গম ক্রেতা ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছে, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার কারণে মিসর, লেবানন, ইয়েমেনসহ আরব অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের মানুষের পাতে রুটির সংখ্যা আরও কমতে পারে।
খবরে বলা হয়, ইউক্রেন ও রাশিয়া—এ দুই দেশ থেকেই গম আমদানি করে থাকে আরব দেশগুলো। আমদানির ক্ষেত্রে এ দেশ দুটির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল তারা। খাদ্যাভ্যাসের কারণে গমের আটার রুটি এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান খাবার। ফলে যদি এর সরবরাহ ব্যহত হয়, তবে আরব দেশগুলোয় খাদ্য সরবরাহে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা রয়েছে।
‘যুদ্ধের আগে থেকেই আমরা কঠিন পরিস্থিতিতে ছিলাম। কিন্তু এখন সরবরাহ ব্যবস্থায় নতুন সংকট তৈরি হয়েছে
এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউট বলছে, ইউক্রেন সংকটের কারণে যদি গমের সরবরাহ ব্যাহত হয়, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে খাদ্যসংকটের জন্য নতুন করে বিক্ষোভ শুরু হতে পারে এবং পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে।
ইউক্রেনে হামলায় বাধার মুখে পড়তে পারে কৃষ্ণ সাগর দিয়ে বাণিজ্যিক জাহাজের চলাচল। এর প্রভাব হবে মারাত্মক। এতে এ পথ দিয়ে আমদানি-রপ্তানি করা খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যেতে পারে। করোনা মহামারির কারণে এর মধ্যেই বিশ্বের অনেক অঞ্চলের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ফলে নতুন করে খাদ্যের দাম বাড়লে তা সংকট বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাদ্যশস্যের অন্যতম চার রপ্তানিকারক দেশ ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান ও রোমানিয়া। এই দেশগুলোর পণ্য রপ্তানি হয় কৃষ্ণ সাগরের বিভিন্ন বন্দর দিয়ে। গম রপ্তানির দিকে দিয়ে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে রাশিয়া। ইন্টারন্যাশনাল গ্রেইনস কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম ভুট্টা রপ্তানিকারক দেশ হতে যাচ্ছে ইউক্রেন। আর গম রপ্তানিতে দেশটির অবস্থান চতুর্থ।
ইউবিএসের কৌশলবিদ ডমিনিক স্নাইডার বলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি অনেক বেড়েছে। এটি আগামীতে গমের দাম বাড়িয়ে দিতে পারে।
রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়ই বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উৎপাদক। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের তথ্যমতে, বিশ্বে সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ইউক্রেন প্রথম ও রাশিয়া দ্বিতীয়। এ দুই দেশে বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়।
এছাড়া জেপি মরগানের হিসাবে, বিশ্বের অন্তত ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ গম উৎপাদন হয় ইউক্রেন-রাশিয়ায়। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে শিকাগো ফিউচার এক্সচেঞ্জে গমের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণ ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা। আর হামলার মুখে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনের সরবরাহও আপাতত শূন্য। বিশ্বব্যাংক প্রধানের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধের ক্ষতি দ্রুত পূরণের কোনো রাস্তা নেই। তাই দাম বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের মতো করে একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সেই ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু করে মূলত চারটি দেশ। যেমন, চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। এ রকম এক অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত কেবল এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা বিশ্ব অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হানবে।
বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, খাদ্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে। মুডিস বলছে, করোনার কারণে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খল ইতিমধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে আরো বিশৃঙ্খলা বাড়তে পারে এই যুদ্ধের কারণে। বিশ্বে শেয়ার বাজারগুলোতে অস্হিরতা চলছে। জ্বালানির কথা চিন্তা করলে ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান মানবিক ও আর্থিক সংকট ডেকে আনবে। কারণ ইউরোপ জ্বালানির জন্য অনেকাংশে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এখন রাশিয়া সরবরাহ বন্ধ করলে দুর্ভোগে পড়তে হবে ইউরোপকে। সেটা না হলেও রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি পাওয়া তাদের জন্য আর সস্তা ও সহজ হবে না।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৪৮
আপনার মতামত জানানঃ