করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা এখনো কাটেনি। ২০২০–এর মন্দার পরে, ২০২১ সালে উত্তরণের কিছু লক্ষণ ছিল। কিন্তু নতুন বছরের দুই মাস না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সংকটে ফেলে দিয়েছে।
সামরিক যুদ্ধের বিপরীতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো শুরু করেছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। আরোপ করা হয়েছে নানা নিষেধাজ্ঞা। এতে কেবল রাশিয়া বা ইউক্রেন সংকটে পড়বে তা নয়, প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আগে থেকেই ছিল, এখন যুক্ত হচ্ছে নিম্ন প্রবৃদ্ধি। নতুন এক মন্দার মুখে সারা বিশ্ব।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ভাটা পড়বে বলে আশঙ্কা করছে বিশ্বব্যাংক। এতে বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর দরিদ্র জনগোষ্ঠী সংকটের সম্মুখীন হবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
শুক্রবার (৪ মার্চ) বিবিসি’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংক প্রধান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধ এমন এক খারাপ সময়ে আসলো, যখন আগে থেকেই বিশ্ব মূল্যস্ফীতির সংকটে ছিল।
তিনি বলেন, ইউক্রেন সীমান্তের বাইরেও এই যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব পড়ছে। জ্বালানির দাম বাড়ছে, বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। আর এগুলোতে গরিব দেশগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মালপাসের কথায়, যুদ্ধের জন্য খাদ্যের দাম বাড়ছে। এটি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সত্যিকারে সমস্যা ও চিন্তার বিষয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন উভয়ই বিশ্বের অন্যতম খাদ্য উৎপাদক। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের তথ্যমতে, বিশ্বে সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে ইউক্রেন প্রথম ও রাশিয়া দ্বিতীয়। এ দুই দেশে বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ সূর্যমুখী তেল উৎপাদন হয়।
এছাড়া জেপি মরগানের হিসাবে, বিশ্বের অন্তত ২৮ দশমিক ৯ শতাংশ গম উৎপাদন হয় ইউক্রেন-রাশিয়ায়। যুদ্ধের কারণে এরই মধ্যে শিকাগো ফিউচার এক্সচেঞ্জে গমের দাম ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ হওয়ার কারণ ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা। আর হামলার মুখে বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইউক্রেনের সরবরাহও আপাতত শূন্য। বিশ্বব্যাংক প্রধানের মতে, রাশিয়া-ইউক্রেন থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধের ক্ষতি দ্রুত পূরণের কোনো রাস্তা নেই। তাই দাম বাড়ছে।
যুদ্ধের জন্য খাদ্যের দাম বাড়ছে। এটি দরিদ্র দেশগুলোর জন্য সত্যিকারে সমস্যা ও চিন্তার বিষয়।
একই কথা রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের ক্ষতির বিষয়টি। ডেভিড মালপাসের অভিযোগ, রাশিয়াকে বাদ দিয়ে কীভাবে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবস্থা হবে, তা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করেটি ইউরোপীয় দেশগুলো। এ অঞ্চলের প্রায় ৩৯ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে, আর তার বড় উৎস রাশিয়া থেকে আসা তেল ও গ্যাস।
বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়ালে রাশিয়া স্থায়ীভাবে কিছু বাজার হারাতে পারে। এভাবে আয় কমে যাওয়ায় সেখানে জীবযাত্রার মান যেমন কমবে, তেমনি রুবলের দরপতন এবং মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার এ ধরনের আরও ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এমনিতেই কোভিডের সময় সরবরাহ–ব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছিল। এখন তা আরও বাড়বে। এতে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ ঋণের সুদহার বৃদ্ধিসহ যেসব ব্যবস্থা নেবে, তাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমবে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি-নিম্ন প্রবৃদ্ধির দিকেই যাচ্ছে। অর্থনীতির এই মন্দাবস্থাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলা হয়। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, আবার কর্মসংস্থানও তৈরি হয় না। সংকট উভয় দিকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের মতো করে একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সেই ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু করে মূলত চারটি দেশ। যেমন, চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। এ রকম এক অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত কেবল এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা বিশ্ব অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হানবে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা গ্যাসের দাম আরও বাড়তে পারে। কারণ, এমনটি হলে ইউক্রেন ও বেলারুশের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে গ্যাসের সরবরাহ কমে আসবে।
উক্রেন-রাশিয়া সংঘাতে সংকটে পড়তে পারে জ্বালানি তেলের বাজারও। রাশিয়া থেকে উত্তোলন করা জ্বালানি তেল ইউক্রেন হয়ে স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি ও চেক প্রজাতন্ত্রে যায়। ২০২১ সালে ইউক্রেনের মধ্য দিয়ে দেশগুলোতে ১ কোটি ১৯ লাখ টন অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করে মস্কো। যেখানে আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ১ কোটি ২৩ লাখ টন।
আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান জে পি মরগান বলছে, সংঘাত শুরু হলে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ব্যারেলপ্রতি ১৫০ মার্কিন ডলারে দাঁড়াতে পারে। ফলে বছরের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক জিডিপির প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়াতে পারে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশে। একই সঙ্গে মুদ্রাস্ফীতি দ্বিগুণের বেশি বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ হতে পারে।
যুদ্ধের ফলে সংকটে পড়তে পারে পশ্চিমা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে রয়েছে তারা। দেশটির সবচেয়ে বড় জ্বালানি তেল উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান রসনেফটে ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক জ্বালানি প্রতিষ্ঠান বিপির। প্রতিষ্ঠানটির মোট উত্পাদনের তিন ভাগের এক ভাগ আসে রসনেফট থেকে। এ ছাড়া যৌথভাবে দুই প্রতিষ্ঠানের একাধিক ব্যবসা রয়েছে।
ইউক্রেনে হামলা হলে এর প্রভাব পড়বে আর্থিক খাতেও। বেশি সমস্যায় পড়তে পারে ইউরোপের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। জে পি মরগানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, অস্ট্রিয়ার রাইফেইসেন ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল, হাঙ্গেরির ওটিপি ও ইউনিক্রেডিট ব্যাংক, ফ্রান্সের সোসায়েটে জেনারেল ব্যাংক, নেদারল্যান্ডসের আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইএনজির ব্যবসা রয়েছে রাশিয়ায়। এসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার একটি অংশ আসে রাশিয়া থেকে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩২৮
আপনার মতামত জানানঃ