নারী নির্যাতনে চতুর্থ বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন খবরের কাগজে শিশু নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। এর বাইরেও নির্যাতনের অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। নিরপরাধ শিশুরা শিকার হচ্ছে খুন, ধর্ষণ কিংবা ভয়াবহ নির্যাতনের। এসব ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দৃষ্টান্ত খুব বেশি পরিলক্ষিত হয় না। অনেক সময় ভোক্তভোগী আইনের আশ্রয় নিলেও অপরাধী ফাঁকফোকরে ছাড়া পেয়ে যায়। করোনা মহামারিতে মানুষ যখন বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছে, তখনও শিশুর প্রতি সহিংসতা বন্ধ নেই বরং বেড়েছে।
দেশে শিক্ষার্থীরাই বেশি যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশই শিক্ষার্থী বলে সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের জরিপ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এ অবস্থায় নারীদের ওপর যৌন হয়রানি বন্ধে উচ্চ আদালতের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকলেও তা এখনো কার্যকর হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আজ ৪ মার্চ পালিত হচ্ছে বিশ্ব যৌন নিপীড়নবিরোধী দিবস।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে মোট ২৬৫ জন নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ৪৬ শিশুসহ ৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে তিন শিশুসহ ১২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার এবং এক শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া ছয় শিশুসহ আট নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এক শিশুসহ চার নারী শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছেন। এক শিশুসহ তিনজন যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০২১’ শিরোনামে শিশুবিষয়ক সংবাদের তথ্য বিশ্লেষণ করে উন্নয়ন সংস্থা ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ)’ জানায়, করোনার কারণে বিগত বছরের বেশির ভাগ সময় জনসমাগমস্থলে শিশুদের তেমন উপস্থিতি না থাকলেও ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৮১৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের এই সংখ্যা ছিল ৬২৬। এ ছাড়া একই সময়ে আরো ৯৪ শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণের শিকার হয়ে মারা গেছে ১৪ মেয়েশিশু। এই সময়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১১০টি শিশু।
মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) জরিপের তথ্যে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালে ৬৯২ নারী ও ৯৪৫ শিশু-কিশোরী যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ১১ নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন তিন নারী। ধর্ষণের চেষ্টার শিকার ৮২ ও যৌন হয়রানির শিকার হন আরো ৮২ নারী। অবশ্য বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০০ জনে সাত নারী কোনো না কোনোভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন বলে তথ্য দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
হয়রানির আশঙ্কায় যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানা উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। ’
এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য এসেছে, তা যাচাই-বাছাই করে এই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাস্তবে ঘটনা আরো বেশি। কারণ হয়রানির আশঙ্কায় যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরা প্রতিবাদ করতেও ভয় পায়। যৌন নিপীড়ন বন্ধে সরকারি নানা উদ্যোগ থাকলেও তা কার্যকর ভূমিকা রাখছে না। ’
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১০ সালে উচ্চ আদালত যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি নির্দেশনা দেন।
তাতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে নারী রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে যৌন নিপীড়নবিরোধী কমিটি থাকতে হবে। কমিটিতে নারীদের প্রাধান্য থাকতে হবে। একটি বাক্সে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি তিন মাস পর ওই বাক্স খুলে কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে কমিটি। তদন্তে নিরপেক্ষ ফল পেতে গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। কেউ চাইলে সরাসরি কমিটির কাছে অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু ১২ বছর পরে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কিছু প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কমিটি থাকলেও বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়। যৌন হয়রানির শিকার নারীই উল্টো সামাজিকতার ভয়ে গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এ বিষয়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে না। এটি নির্মূল করতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সচেতনতামূলক কর্মসূচিও জরুরি। দিবসটিকে ধরে প্রচার-প্রচারণা ও বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা মনে করেন।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেন, আমরা কোভিড-১৯ মহামারির চেয়েও ভয়ংকর, নিষ্ঠুর ও বর্বর মহামারি নারী ও শিশুদের ওপর যৌনসহিংসতা, ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াই করছি। বিগত কয়েক বছর ধরে যৌন সহিংসতার মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায় যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি নৃসংসতার ঘটনার সুষ্ঠ তদন্ত করা সম্ভব হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রাপ্য সম্মান দেওয়া হয় না। সেক্ষেত্রে পরিবার থেকে প্রতিটি প্রজন্ম শিখছে মেয়েরা মানুষ নয়, তারা শুধু ব্যবহারের জন্য। এভাবে পরিবার থেকেই মূলত নারীর প্রতি অসম্মানের শুরু। এতে বাড়ছে নারী ও শিশু নির্যাতনের হার। নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নের কথা বলছে রাষ্ট্র। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা নারীদের সম্মানের জায়গায় তুলে ধরতে পারছি না।’
তারা বলেন, ‘পরিবার থেকেই নারীদের সম্মান দেওয়ার শিক্ষাটা জরুরি। পাশাপাশি আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় যা রয়েছে তা একপ্রকার ইঁদুর দৌড়ের মতো। আমরা শুধু দৌড়াচ্ছি আর দৌড়াচ্ছি। মানবিক শিক্ষা না শিখে ডিগ্রির পেছনে দৌড়াচ্ছি। পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মানবিক শিক্ষা শুরু করা দরকার।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩০১
আপনার মতামত জানানঃ