করোনা মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা এখনো কাটেনি। ২০২০–এর মন্দার পরে, ২০২১ সালে উত্তরণের কিছু লক্ষণ ছিল। কিন্তু নতুন বছরের দুই মাস না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে নতুন করে সংকটে ফেলে দিয়েছে।
সামরিক যুদ্ধের বিপরীতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো শুরু করেছে অর্থনৈতিক যুদ্ধ। আরোপ করা হয়েছে নানা নিষেধাজ্ঞা। এতে কেবল রাশিয়া বা ইউক্রেন সংকটে পড়বে তা নয়, প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি আগে থেকেই ছিল, এখন যুক্ত হচ্ছে নিম্ন প্রবৃদ্ধি। নতুন এক মন্দার মুখে সারা বিশ্ব।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে, আর এটাই সবচেয়ে ভয়ের কথা। কেননা অর্থনীতির বড় শত্রু অনিশ্চয়তা।
বিশ্ব অর্থনীতি যেভাবে পঙ্গু হয়ে যাবে
এমনিতেই কোভিডের সময় সরবরাহ–ব্যবস্থায় বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছিল। এখন তা আরও বাড়বে। এতে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশ ঋণের সুদহার বৃদ্ধিসহ যেসব ব্যবস্থা নেবে, তাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি কমবে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি অতি উচ্চ মূল্যস্ফীতি-নিম্ন প্রবৃদ্ধির দিকেই যাচ্ছে। অর্থনীতির এই মন্দাবস্থাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘স্ট্যাগফ্লেশন’ বলা হয়। এতে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ে, আবার কর্মসংস্থানও তৈরি হয় না। সংকট উভয় দিকেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের মতো করে একটি বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। সেই ব্যবস্থায় চ্যালেঞ্জ জানানো শুরু করে মূলত চারটি দেশ। যেমন, চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া। এ রকম এক অবস্থায় রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত কেবল এই দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তা বিশ্ব অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থায় বড় ধরনের আঘাত হানবে।
সামরিক খাতে বড় খেলোয়াড় হলেও রাশিয়া অর্থনীতির মাঠে বড় শক্তি নয়। রাশিয়ার অর্থনীতির আকার এখন ১ দশমিক ৪৮ ট্রিলিয়ন ডলার (১০০ কোটিতে ১ বিলিয়ন, ১ হাজার বিলিয়নে ১ ট্রিলিয়ন)। তুলনা করলে যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য ক্যালিফোর্নিয়া (২ দশমিক ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার), টেক্সাস (১ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন) এবং নিউইয়র্কের (১ দশমিক ৬৮ ট্রিলিয়ন) চেয়েও ছোট অর্থনীতি রাশিয়ার। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির আকারই ২০ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। মোট বৈশ্বিক উৎপাদনে রাশিয়ার অংশ এখন মাত্র ১ দশমিক ৭ শতাংশ।
তবে রাশিয়া জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসে বিশ্বের অন্যতম বড় শক্তি। দেশটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম জ্বালানি তেল উৎপাদক। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের পরেই রাশিয়া। প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ হিসেবেও রাশিয়া দ্বিতীয় অবস্থানে, শীর্ষস্থানে যুক্তরাষ্ট্র। জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালিসহ ইউরোপ মূলত রাশিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। এই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে ইউরোপের কলকারখানা কার্যত বন্ধ হয়ে যাবে।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জোরদার করা হলেও সব পক্ষই জ্বালানি নিষেধাজ্ঞাকে সচেতনভাবেই এড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ, রাশিয়া জ্বালানি তেল ও গ্যাস রপ্তানিতে অন্যতম শীর্ষ দেশ। বিশেষ করে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্ষেত্রে পুরো ইউরোপ প্রায় রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল।
তবে সরবরাহ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি মূল্য নিয়ে দেখা দিয়েছে সংকট। সব ধরনের সরবরাহ–ব্যবস্থা এমনিতেই করোনার সময় থেকেই ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, ৩৬টি দেশের সঙ্গে এখন রাশিয়ার বিমান যোগাযোগ বন্ধ। এতে পণ্য পরিবহনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেক জাহাজকে ঘুরে যেতে হবে। ফলে কনটেইনার পরিবহন ব্যয়ও বাড়বে। এমনকি বেড়ে যাবে বিমানে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও। পরিবহন ব্যয় মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেবে।
আশঙ্কা আছে খাদ্যশস্য ও বেশ কিছু ধাতব পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়েও। বিশেষ করে রাশিয়া ও ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম গম ও ভুট্টা উৎপাদন ও রপ্তানিকারক। গমের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেকখানি নির্ভর করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ওপর।
আবার প্যালাডিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম ও নিকেলের জন্যও অনেক দেশ রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এসব ধাতব মুঠোফোন থেকে শুরু গাড়ি তৈরির জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য।
বাংলাদেশ যে ক্ষতির মুখোমুখি
বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা বিপদে ফেলবে বাংলাদেশকেও। মূল্যস্ফীতির চাপ সীমিত আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে। রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিনিয়োগও কমবে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, যুদ্ধ যদি বেশি দিন চলে তাহলে বিশ্ব অর্থনীতি একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে চলে যাবে। বাংলাদেশও এ থেকে মুক্ত থাকবে না।
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার এখন ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। তবে সরকারি এই তথ্যের ওপর আস্থা কম। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেশি। ইউক্রেন সংকট বাংলাদেশকেও সংকটে ফেলবে। আশঙ্কা আছে রপ্তানি ও বিনিয়োগ নিয়েও। বাংলাদেশের পোশাক যায় ইউরোপে। আবার বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম আমদানি করে।
গবেষণা সংস্থা সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে বলেন, যুদ্ধের স্থায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এর ওপরই নির্ভর করছে অনেক কিছু। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ আশঙ্কাজনক। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ব্যারেলপ্রতি ১১৩ ডলার। বাড়ছে গ্যাসের দামও।
এর প্রভাবে বাড়বে সারের দাম। বোরো ফসলের ক্ষেত্রে সারের দাম যদি বাড়ে, তাহলে তা ভয়াবহ সংকট হিসেবেই দেখা দেবে। ভর্তুকি সামাল দেওয়া কঠিন হবে। পরের শঙ্কাটি ব্যাংকিং লেনদেনে রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা–সংক্রান্ত।
এর প্রভাব পড়তে পারে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে। এ যুদ্ধের কারণে ইউরোপে চাহিদা কমে গেলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সহায়তা—সব সম্পর্কের ক্ষেত্রেই বিপদে পড়বে বাংলাদেশ। এমনিতেই চাপের মধ্যে ছিল দেশ। এর সঙ্গে এখন যুক্ত হলো যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সেই চাপকেই আরও ঘনীভূত করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ