পুলিশ সবচেয়ে বড় ভিলেনে পরিণত হয়েছে এই সময়ে। বর্তমানে পুলিশের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে মামলা হয়েছে এবং বিচার চলছে। এর মাঝেই এক নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলায় হাতিরঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রশিদ, ওসি (তদন্ত) মহিউদ্দিন ফারুক, ওসি (অপারেশন) গোলাম আজম ও দুই এসআইসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল নং ৭-এ মামলা করা হয়। বিচারক জুলফিকার হায়াত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে পরে আদেশ দেবেন বলে জানিয়েছেন।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন— তানিম রেজা বাপ্পি, পান্নু হাওলাদার, ইউসুফ রিপন, কাজী তোফাজ্জল হোসেন, জাভেল হোসেন পাপন, মোহাম্মদ জামাল, রাকিবুল হাসান, এসআই শরিফুল, এসআই চয়ন ও মোসাম্মৎ আলেয়া।
ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্তদের সহযোগিতা করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
ভুক্তভোগী নারী জানান, মামলার ১ নম্বর আসামি তানীম রেজা বাপ্পী ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর ভুয়া কাবিননামা তৈরি করে বিয়ের কথা বলে তাকে দীর্ঘদিন ধরে ধর্ষণ করে আসছিলো। এ বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি হাতিরঝিল থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা না নিয়ে তাকে নানাভাবে হয়রানি করে। পরবর্তীতে মামলার প্রধান আসামি এবং ভুক্তভোগীর কথিত স্বামী বাপ্পীসহ তার সহযোগীরা নারীকে রিকশা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা ও গুমের চেষ্টা করে। পরবর্তীতে হাতিরঝিল থানায় মামলা না নিলে আজ মঙ্গলবার দুপুরে যুবলীগ নেতা জাভেল হোসেন পাপন, হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদ, ওসি তদন্ত মহিউদ্দিন ফারুক, ওসি অপারেশন গোলাম আজম ও দুই এসআই’সহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ আইনে নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল নং ৭ এ মামলা দায়ের করেছেন ভুক্তভোগী নারী।
মামলার ৫ নম্বর আসামী জাভেল হোসেন পাপন, বর্তমানে ৩৭নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি, ক্যাসিনো কান্ডে সম্রাটের সহযোগী ছিলেন।
মামলার আরজিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বাদী একজন স্বামী ‘পরিত্যক্তা’ নারী। তিনি খিলগাঁওয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। প্রায় এক বছর আগে তার সঙ্গে রাজধানীর ডেমরা রসুলপুরের তানিম রেজা বাপ্পির পরিচয় হয়। ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর আসামি তানিম তার সহযোগীদের নিয়ে মামলার বাদীর ভাড়া বাসায় আসেন। সেখানে তানিম বাদীকে বিয়ে করেন। বিয়েটা ছিল সাজানো। দুই মাস ঘর-সংসার করেন। এরপর বাদীর সন্দেহ হয়। তিনি কাবিননামা চান। তাঁরা বিয়ের কাজী তোফাজ্জল হোসেনের বাড়িতে যান। বাদী জানান, তাঁদের বিয়ের কোনো কাগজপত্র নেই। বিয়ের নাটক সাজিয়ে তানিম রেজা বাপ্পি বাদীকে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়।
হাতিরঝিল থানার ওসি ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলা নেননি। তারা আসামিদের সহায়তা করেছেন। এ কারণে এ মামলায় পুলিশদের আসামি করা হয়েছে।’
মামলায় আরও অভিযোগ করা হয়, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মামলার বাদীকে তানিম রেজা হাতিরঝিলের পাশের একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখানে নিয়ে জাভেল হোসেন পাপন ও মোহাম্মদ জামালও বাদীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন। বাদী ৯৯৯-এ ফোন করলে পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বাদী সুস্থ হয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি হাতিরঝিল থানায় এজাহার দায়ের করেন। থানার ওসিসহ অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা কয়েকজন আসামিকে আটক করেন। কিন্তু আসামিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে তারা এই মামলা না নিয়ে বাদীকে ১ লাখ টাকা নিয়ে আপস করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। বাদী মামলায় অভিযোগ করেন, অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তারা ধর্ষণের কোনো প্রতিকার না করে ধর্ষণকারীদের সহায়তা করেছেন।
বাদী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘হাতিরঝিল থানার ওসি ও অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা আসামিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলা নেননি। তারা আসামিদের সহায়তা করেছেন। এ কারণে এ মামলায় পুলিশদের আসামি করা হয়েছে।’
বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পুলিশের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা অব্যাহত রয়েছে। কোথাও মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগ আসে পুলিশের বিরুদ্ধে, কোথাওবা অস্ত্র বিক্রয়কারী হিসাবে, কোথাওবা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ, অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ, পুলিশের নেতৃত্বে মাদক পাচার চক্র গড়ে ওঠার অভিযোগ, চুরি ডাকাতি ইত্যাদি হেন কোনো অপরাধ নেই যা পুলিশ শব্দটির সাথে জুড়ে বসে নাই। প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে এমনসব অভিযোগ আসে। এমনকি আসছে ধর্ষণের অভিযোগও।
পুলিশ বিভাগের নিজস্ব রিপোর্টে দেখা গেছে, শুধু ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ১৩৩ জন কনস্টেবল ও এএসআই’এর লঘুদণ্ড ও ৪৮৯ জনের গুরুদণ্ড হয়েছে। একই সময়ে ৩৮ জন পুলিশ পরিদর্শকের লঘুদণ্ড ও ৮ জনের গুরুদণ্ড হয়েছে। গত দুই বছর আনুষ্ঠানিকভাবে বিভাগীয় কোনো উপাত্ত পুলিশ প্রকাশ না করলেও ডিপার্টমেন্টাল শাস্তির ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে।
পুলিশ সদস্যরা নিজেরা কেন এভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামো থেকে পুলিশ বাহিনী এখনো বের হতে পারেনি। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি করা যায়নি তাদের কাঠামো। ১৮৬১ সালের আইন দিয়ে পুলিশ পরিচালিত হচ্ছে। এত দিনেও কাঠামোগত সংস্কার করা যায়নি।
বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে মূল সমস্যা খতিয়ে দেখতে হবে। আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে আমাদের। ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করে লাভ নেই। পুরো সিস্টেমটা নিয়ে ভাবতে হবে। বিশেষ করে বিচার ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘাট, প্রসিকিউসন, তদন্ত ব্যবস্থা আছে। বিসিএস দিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ভালো অফিসার ও কাজ দেখালে হবে না, জবাববদিহিতা স্বচ্ছতা, জরুরি।
মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর্ম পরিবেশ নিয়েও ভাবতে হবে। স্থানীয় এমপি, অর্থশালীদের সঙ্গে ওসিদের একটা আঁতাতের সম্পর্ক থাকে। তারা একজন আরেকজনকে প্রটেকশন দেয়। আর সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হয়। ওসি, এসআই লেভেলে সংস্কার জরুরি বলে মনে করেন অধ্যাপক জিয়া রহমান।
তিনি বলেন, তাদের বড় ধরনের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ জরুরি। তাদের আচার ব্যবহার সম্পর্কে আরও সচেতনতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। চেইন অব কমান্ডে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। উনবিংশ শতাব্দীর পুলিশ দিয়ে এই যুগে চলতে পারে না। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ, শাস্তির ব্যবস্থা, ঘটনার শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে দ্রুততম সময়ে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পুলিশের বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ার হার আশংকাজনক। প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে বিভিন্ন অপকর্মের। এবিষয়ে পুলিশের কর্তৃপক্ষসহ দেশের সরকাকেও নজর বাড়াতে হবে। কেননা, আইন রক্ষাকারী কর্তৃক একেরপর এক আইন বিরোধী কর্মকাণ্ডে দেশের আইনের প্রতি মানুষের অনাস্থা জন্মাবে। ফলশ্রুতিতে দেশে দেখা দিবে বিশৃঙ্খলা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনের খড়্গ চালানোর আগে পুলিশের ওপর চালানো প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা। তারা বলেন, আগে পুলিশকে অপরাধমুক্তের চরিত্র অর্জন করতে হবে। নইলে সন্ত্রাসীদের নিকট পুলিশের যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হচ্ছে, এতে পুলিশ আর সন্তাসীদের মধ্যকার তফাৎ ঘুচে যায়।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০৩০
আপনার মতামত জানানঃ