বাংলাদেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাতীয় দ্রব্য ব্যবহার করে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে ১ লাখ ৬১ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এ অবস্থায় তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন জরুরি বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর হোটেল লা ভিঞ্চিতে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত কর্মশালায় এসব তথ্য জানানো হয়।
কর্মশালায় সার্বিক সহযোগিতায় ছিল ক্যাম্পেইন ফর টোবাকো ফ্রি কিডস। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রেজিস্ট্রার (ক্লিনিক্যাল রিসার্চ) ডা. শেখ মো. মাহবুবুস সোবহান।
তিনি বলেন, তামাকজাত দ্রব্যের বহুল ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যান্সার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। দেশে প্রতিবছর তামাকজনিত রোগে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে। তামাকের এসব ক্ষতি থেকে জনস্বাস্থ্যকে রক্ষায় এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০৪০ সালের মধ্যে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রয়োজন বলে মত দেন বক্তারা।
ক্যাম্পেইন ফর টোবাকো ফ্রি কিডসের লিড পলিসি অ্যাডভাইজর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটির বিভিন্ন দিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তারপরও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতাগুলো সংশোধন করা হলে, আইনটি আরও কার্যকর হবে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী সংবাদকর্মীরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী নীতিনির্ধারকদের কাছে তুলে ধরার কথা বলেন। এগুলো হলো সব ধরনের পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনকে শতভাগ তামাকমুক্ত করা, দোকানে তামাকজাত দ্রব্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির সিএসআর নিষিদ্ধ করা, ই-সিগারেট আমদানি, উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে মুদ্রিত সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার বৃদ্ধি করা এবং তামাক দ্রব্যের খুচরা বিক্রি নিষিদ্ধ করা।
বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি রাশেদ রাব্বি বলেন, জনস্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করছে হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম। এই ফোরামের সদস্যরা তামাক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন করেন। তারা সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের সচেতন করবেন।
দেশে বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনটির বিভিন্ন দিক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এফসিটিসির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, তারপরও কিছু জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে। এই দুর্বলতাগুলো সংশোধন করা হলে, আইনটি আরও কার্যকর হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তামাক ছাড়ার সুফল অনেক। যদি কোনো ব্যক্তি টানা ১ বছর তামাকমুক্ত থাকতে পারেন তবে, তার হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি ধূমপায়ীর তুলনায় অর্ধেক কমে যায় এবং ধূমপান ছাড়ার ১০ বছরের মধ্যে ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি অর্ধেকে নেমে আসে। এছাড়া ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সের মধ্যে তামাক ছাড়লে প্রত্যাশিত আয়ু তামাক ব্যবহারকারীর তুলনায় প্রায় ১০ বছর বেড়ে যায়।
তারা আরও বলছেন, শ্বাসতন্ত্র এবং হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ তামাক। তামাক ব্যবহারে করোনারি হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি ২ থেকে ৪ গুণ বেড়ে যায় এবং মুখ গহ্বর, ফুসফুস, খাদ্যনালিসহ প্রায় ২০ ধরনের ক্যানসার হয়। অধূমপায়ীর তুলনায় ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে ২৫ গুণ। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস সংক্রমণে (সিওপিডি) ধূমপায়ীদের মৃত্যুঝুঁকি অধূমপায়ীদের তুলনায় ১৩ গুণ পর্যন্ত বেশি।
সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারিতে ধূমপায়ীদের গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রসহ পাবলিক প্লেস ও পরিবহনে ৩ কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে ৪ কোটি ৮ লাখ মানুষ এবং এক্ষেত্রে নারীরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় ঢাকার প্রাথমিক স্কুলে পড়া ৯৫ শতাংশ শিশুর শরীরে উচ্চমাত্রার নিকোটিন পাওয়া গেছে, এর মূল কারণ পরোক্ষ ধূমপান।
গ্যাটস ফলাফলে আরও দেখা গেছে, ২০০৯ সালের তুলনায় একজন বিড়ি সেবনকারীর বিড়ি বাবদ মাসিক খরচ বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। অন্যদিকে সিগারেট কিনতে একজন ধূমপায়ীর গড় মাসিক ব্যয় হয় ১০৭৭ দশমিক ৭ টাকা। অথচ শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য একটি পরিবারের মাসিক গড় ব্যয় যথাক্রমে মাত্র ৮৩৫ দশমিক ৭ টাকা।
তামাকের জন্য ব্যয়িত অর্থ শিক্ষা ও চিকিৎসা দারিদ্র্য তথা মানবদারিদ্র্য মোকাবিলায় ব্যয় করা গেলে পরিবারগুলোর জীবনমানে উন্নতি ঘটানো সম্ভব।
বিশ্লেষকরা বলেন, অতি গতিশীল সমাজে চিন্তায়-চেতনায় গতি থাকতে হবে। ধূমপান শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র কর বাড়িয়েই ধূমপান রোধ করতে পারব কি না, এটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। বৃদ্ধি করা করের টাকা, স্বাস্থ্যখাতে ব্যবহার করা যেতে পারে। ধূমপানে বিষপান সে বিষয়টিই কেন এখনও তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি না, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। জনমত তৈরি করা দরকার। প্রাক-বাজেটের বেশির ভাগেই কর কমানো প্রস্তাব থাকে, কেবলমাত্র প্রজ্ঞা-আত্মার পক্ষ থেকে কর বৃদ্ধি প্রস্তাব সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে পারে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৩০
আপনার মতামত জানানঃ