রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণ শুরুর পর কিয়েভের বিভিন্ন শহর থেকে প্রাণভয়ে বাড়িঘর ফেলে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটছে মানুষ। একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসায় গাড়ি ও বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। ন্যুনতম প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে গুছিয়ে অসংখ্য মানুষ পায়ে হেঁটে রেলস্টেশনে ছুটছেন।
এক বছর আগে আফগানিস্তান ছেড়ে ইউক্রেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন আজমল রাহমানি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো ইউক্রেনেই শান্তিতে দিন কাটাতে পারবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গত বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। ফলে চলতি সপ্তাহে পরিবার নিয়ে আবারও অন্য দেশে পাড়ি দিয়েছেন আজমল রাহমানি।
এবার তারা ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ডে আশ্রয় নিচ্ছেন। ইউক্রেন ছেড়ে পোল্যান্ড সীমান্তে ঢোকার পর বার্তা সংস্থা এএফপিকে রাহমানি বলেন, আমি একটি যুদ্ধ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানেও এখন আরও একটি যুদ্ধ শুরু হলো। খুবই দুর্ভাগ্য।
তার সঙ্গে স্ত্রী মিনা, ছেলে ওমর (১১) এবং সাত বছরের মেয়ে মারওয়াও ছিল। পুরো পরিবার নিয়ে শেষ কয়েক ঘণ্টায় তিনি ৩০ কিলোমিটার (১৯ মাইল) পথ পাড়ি দিয়েছেন।
পোল্যান্ডের মেডিকায় পৌঁছানোর পর তার পরিবার অন্যান্য শরণার্থীদের সঙ্গে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তারা সেখান থেকে প্রেজেমিসল শহরে যাবেন।
গত কয়েক দিনের সংঘাতে ইউক্রেন ছেড়ে প্রতিবেশী পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং রোমানিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
আফগানিস্তান, গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, ভারত এবং নেপালের বহু অভিবাসী ইউক্রেনে শিক্ষার্থী বা শ্রমিক হিসেবে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু সংঘাতের কারণে তারা সবাই এখন বিপাকে পড়েছেন।
৪০ বছর বয়সী রাহমানি বলেন, আমরা সব হারিয়েছি। তিনি জানিয়েছেন, এর আগে তিনি আফগানিস্তানের কাবুল বিমানবন্দরে ১৮ বছর ধরে ন্যাটো হয়ে কাজ করেছেন।
আমি একটি যুদ্ধ থেকে পালিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু এখানেও এখন আরও একটি যুদ্ধ শুরু হলো। খুবই দুর্ভাগ্য।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র যখন সেনা প্রত্যাহার শুরু করে তার চার মাস আগেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন রাহমানি। কারণ প্রতি নিয়ত তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। ভয়ে তিনি তার সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারছিলেন না।
তিনি বলেন, আফগানিস্তানে আমার জীবন-যাপন খুবই ভালো ছিল। আমার নিজের বাড়ি-গাড়ি ছিল, ভালো বেতন ছিল। কিন্তু আমি সব কিছু বিক্রি করে এখানে এসেছি। এখন আর কিছুই নেই।
রাহমানি জানান, আফগানিস্তান ছেড়ে অন্য দেশের ভিসা পেতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। এরপরেই তিনি ইউক্রেনে যাওয়ার সুযোগ পান।
তারা ওদেসা নামের একটি বন্দর নগরীতে বসবা শুরু করেন। কিন্তু চারদিন আগে তাদের আবারও সব কিছু ত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার জন্য সীমান্ত পার হতে হয়।
পোল্যান্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত কয়েকদিনে ইউক্রেন ছেড়ে প্রায় ২ লাখ ১৩ হাজার মানুষ দেশটিতে আশ্রয় নিয়েছে।
এদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সাত মিলিয়ন অর্থাৎ ৭০ লাখ ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। স্থানীয় সময় রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কমিশনার এ তথ্য জানিয়েছেন।
রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেন থেকে পার্শবর্তী দেশে শরণার্থীর ঢল নামায় বিষয়টি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ইইউর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাবিষয়ক কমিশনার জেনেজ লেনারসিক। এরপর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, আমরা প্রত্যক্ষ করছি যে ইউরোপ মহাদেশে, দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট কি হতে পারে। তিনি বলেন, সম্প্রতি সাত মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পঞ্চম দিন আজ সোমবার। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এদিন ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে ভোরের আলো ফুটেছে বিমান হামলার সতর্কসংকেতের মধ্য দিয়ে। বোমার আঘাত থেকে বাঁচতে শহরের অনেক বাসিন্দা এখনো মাটির নিচে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। গতকাল রোববার রাতভর কিয়েভসহ ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে বিস্ফোরণেরও খবর পাওয়া গেছে।
ইউক্রেন দাবি করেছে, রাজধানী কিয়েভকে লক্ষ্য করে রুশ সেনাদের বেশ কয়েকটি হামলা প্রচেষ্টা থামিয়ে দিতে পেরেছে তারা। স্থানীয় সময় আজ ভোরে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল জেনারেল আলেকজান্ডার সিরস্কি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমরা দেখিয়ে দিয়েছি, অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি থেকে আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে সুরক্ষা দিতে পারি।’
এদিকে গতকাল দিবাগত রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, চেরনিহিভ এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। এর পরপরই ভবনটিতে আগুন ধরে যায়।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছে বিবিসি।
ইউক্রেনে পঞ্চম দিনের মতো রুশ হামলা অব্যাহত রয়েছে। তবে রুশ সেনারা ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধের মুখে পড়ছেন। কয়েকটি শহরে পথে পথে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
গতকাল রুশ বাহিনী ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢুকলেও তাদের প্রতিহত করার কথা জানায় ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ। রাজধানী কিয়েভকেও রুশ সেনামুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছে তারা।
যুদ্ধে ৪ হাজার ৩০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছেন বলে দাবি করেছে ইউক্রেন। রুশ সেনাদের হতাহতের কথা স্বীকার করলেও এ বিষয়ে মস্কোর পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি।
সম্প্রতি পূর্ব ইউক্রেনে সেনা পাঠানোর নির্দেশের আগে রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রিত দুটি অঞ্চলকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। স্থানীয় সময় সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, পূর্ব ইউক্রেন এক সময় রাশিয়ার ভূমি ছিল। পুতিনের এ ঘোষণার পরপরই শুরু হয় ইউক্রেন আগ্রাসন।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৬
আপনার মতামত জানানঃ