আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে হাইকোর্ট বলেছে, বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে যখন রায় বিক্রি করেন তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে করা এক রিট মামলার রায়ে এ অভিমত ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক-আল-জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
গত বছর ১১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে এ রায় দেয়। ১৪৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। রায়ে ঢাকার কাকরাইলের সাড়ে ১৬ কাঠা জমি পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালে ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের রায়কে কল্পিত, জালিয়াতি, অসদভিপ্রায়, স্বেচ্ছাচারী, প্রতারণামূলক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রায় ২৫ বছর আগের ওই রায়ের বিরুদ্ধে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের করা রিট আবেদনটি মঞ্জুর করে হাইকোর্ট।
পরিত্যক্ত সম্পত্তি নিয়ে অধ্যাদেশ জারির পর ১৯৮৮ সালে কে এ এম আশরাফ উদ্দিন ঢাকার কাকরাইলের ৫৬/৫৭ হোল্ডিংয়ের ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৬), লুৎফুন্নেছা রহমান চার কাঠা (বাড়ি নং-৫৬/১) এবং ১৯৮৯ সালে এ কে এম ইদ্রিস হোসেন তালুকদার ও তার স্ত্রী জামিলা খাতুন সাড়ে ছয় কাঠা (বাড়ি নং-৫৭) জমির মালিকানা দাবি করে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে সেগুলো বাতিল চেয়ে সেগুনবাগিচার সেটেলমেন্ট আদালতে আবেদন করেন। আবেদনকারীরা দাবি করেন, তারা ১৯৭৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী তারারাম জয়সুরিয়া ওরফে চিও রতন ওরফে তারারাম মুচির কাছ থেকে এ জমি কিনেছেন। ওই জমিতে বসবাসরত অবস্থায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি উল্লেখ করে ১৯৮৮ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা বোর্ড তাদের নোটিস পাঠায়। পরে আবেদনকারীদের নোটিসের জবাবে সন্তুষ্ট হয়ে এবং কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জামির মালিকানা দাবিকারীদের বিরুদ্ধে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা।
রায়ে আরও বলা হয়, ‘জনগণের সম্পত্তি দেখভালের সবশেষ স্তরে জনগণ বিচারকগণের ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অর্পণ করেন। সুতরাং বিচারকগণের বিশাল গুরুদায়িত্ব হলো জনগণের সম্পত্তি যেন কোনো জোচ্চর, ঠক, বাটপার এবং জালিয়াত চক্র গ্রাস করতে না পারে।’
১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালত চারটি আবেদন একসঙ্গে নিষ্পত্তি করে রায় দেয়। রায়ে আবেদন মঞ্জুর করা হলে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে ওইসব সম্পত্তি বাদ দেওয়া হয়। এরপর সেটেলমেন্ট আদালতের এ রায় চ্যালেঞ্জ করে সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় গত বছর হাইকোর্টে দুটি রিট আবেদন করলে প্রাথমিক শুনানি নিয়ে রুল জারি এবং চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় হয়। এ রায়ে পরিত্যক্ত সম্পত্তির তালিকা থেকে আবেদনকারীদের সম্পত্তি বাদ দিয়ে ১৯৯৫ সালে বিচারক মুসা খালেদের নেতৃত্বাধীন ঢাকার প্রথম সেটেলমেন্ট আদালতের রায়ের কঠোর সমালোচনা করা হয়। রায়ে হাইকোর্ট বলে, ‘তারারাম যে এসব সম্পত্তির মালিক ছিলেন সেটেলমেন্ট আদালতের রায়েই তা প্রমাণ হয়নি। সেটেলমেন্ট আদালত কল্পিত রায় প্রদান করেছেন, যা অযৌক্তিক, জালিয়াতি, প্রতারণামূলক ও ন্যাবিচারের পরিপন্থী।বিচারক ও বিচার বিভাগের বিষয়ে সতর্ক করে রায়ে হাইকোর্ট বলে, ‘মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ। যখন এই শেষ আশ্রয়স্থলের বিচারকরা দুর্নীতির মাধ্যমে রায় বিক্রি করেন, তখন সাধারণ মানুষের আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। সাধারণ মানুষ হতাশ, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, বিক্ষুব্ধ হন এবং বিকল্প খুঁজতে থাকেন। তখনি জনগণ মাস্তান, সন্ত্রাসী এবং বিভিন্ন মাফিয়া নেতাদের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তাদের বিচার সেখানে চান। আমরা বিচার বিভাগ ব্যর্থ হলে জনগণ বিকল্প খুঁজতে বাধ্য হবেন, যেটি কল্পনাও করা যায় না।’
এতে আরও বলা হয়, ‘দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ আইনের শাসনের অন্যতম শর্ত। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ ছাড়া আইনের শাসন কল্পনাও করা যায় না। সুতরাং এখন সময় এসেছে জনগণের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগের আমূল সংস্কার করে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা। বিচার বিভাগকে নির্ভরযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা।’
রায়ে আরও বলা হয়, ‘জনগণের সম্পত্তি দেখভালের সবশেষ স্তরে জনগণ বিচারকগণের ওপর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার অর্পণ করেন। সুতরাং বিচারকগণের বিশাল গুরুদায়িত্ব হলো জনগণের সম্পত্তি যেন কোনো জোচ্চর, ঠক, বাটপার এবং জালিয়াত চক্র গ্রাস করতে না পারে।’
হাইকোর্ট বলে, ‘আইনের শাসন এবং বিচার বিভাগের দুর্নীতি একসঙ্গে চলতে পারে না। বিচার বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে আইনের শাসন বই-পুস্তকেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি বাস্তবে কখনই রূপ লাভ করবে না। দুর্নীতিমুক্ত বিচার বিভাগ গড়ার জন্য সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে বসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ দ্রুত গ্রহণ না করলে ভালো বিচারকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা দেখা যাচ্ছে।’রায়ে আরও বলা হয় বলে, ‘আমাদের সমাজে, বুদ্ধিজীবী মহলে, পত্র-পত্রিকায় এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য খবর, প্রতিবেদন লেখা বা ছাপা হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতিবাজ বিচারকদের (নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত) কীভাবে ছুড়ে ফেলে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট প্রতিবেদন, লেখা বা গবেষণা দেখা যায়নি। বিচার বিভাগের সব বিচারককে যদি দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হয় তাহলে সব দুর্নীতিবাজ বিচারককে চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে তাদের উপড়ে ছুড়ে ফেলে দিতে হবে।’
এতে বলা হয়, ‘আমাদের মেহনতি শ্রমিক ভাইবোনরা কোনোদিন দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি এবং দেশের সম্পদ লুট করার মতো কোনো কর্ম করে না। দেশের সম্পদ লুট করে তথাকথিত শিক্ষিত জনগণের বেতনভোগী কতিপয় কর্মকর্তা- কর্মচারী। সময় এসেছে জনগণের বেতনভোগী এসব দুর্নীতিবাজ এবং লুটেরা বাহিনীকে জনগণের আদালতে দাঁড় করানোর। তা না হলে আইনের শাসন শুধু বইতেই লেখা থাকবে বাস্তবে এটি দেখা যাবে না।’
আপনার মতামত জানানঃ