নয় কোটি ২০ লাখ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা এতো বেশি ছিল যে মেরু অঞ্চলে বড় আকারের বরফের খণ্ড ছিল না। ক্যানাডিয়ান আর্কটিকের মতো উত্তরাঞ্চলে কুমিরের মতো কোন প্রাণীরও অস্তিত্ব ছিল না। তবে তখনও মানুষের আবির্ভাব ঘটেনি। এছাড়াও অতীতে কখনও কখনও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে ২৫ মিটার (৮০ফুট) উঁচু ছিল। হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক বন্যা। এমন এক বন্যার কারণেই আজকের আকার পেয়েছে আমাদের প্রিয় পৃথিবী।
পৃথিবীর আকার অনেকটা কমলা লেবুর মতো। শৈশবে ভূগোলের বইতে আমরা এমনটা পড়েছি সকলেই। কিন্তু আদৌ কি তার আকার মসৃণ কমলা লেবুর মতো? না। বরং, পৃথিবীর ভূত্বক অনেকটা বিকৃত গোলকের মতো। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ইলিপসয়েড।
প্রাচীনকালে, এটি বিশ্বাস করা হত যে আমরা যে পৃথিবীতে বাস করি তা পৃথিবী মহাকাশে বিশ্রামের একটি ফ্ল্যাট ডিস্ক। পরবর্তীকালে, ভ্রমণকারীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে স্থল এবং সমুদ্রের পৃষ্ঠতল সমতল নয়, তবে মসৃণভাবে বাঁকা ছিল। সামোসের গ্রীক বিজ্ঞানী এরিস্টার্কাস পরামর্শ দিয়েছিলেন যে পুরো পৃথিবী একটি বিশাল বল। দেড় হাজার বছর পরে তার অনুমান নিশ্চিত হয়ে গেছে।
পৃথিবী গোল, এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। এর পৃষ্ঠটি হতাশা (সমুদ্র এবং মহাসাগর) এবং বালজেস (মহাদেশ এবং দ্বীপপুঞ্জ) দিয়ে আচ্ছাদিত। এছাড়া কেন্দ্রীভূত শক্তির প্রভাবের অধীনে এটি কিছুটা মেরুতে সংকুচিত হয়, যদিও এই সংক্ষেপণের ডিগ্রি এত কম যে এটি খালি চোখে দেখা যায় না। সাধারণভাবে, পৃথিবী সূর্য বা গ্যাস জায়েন্ট বৃহস্পতি এবং শনির চেয়ে অনেক কম গোলাকৃতির।
আর পৃথিবীর এই গোল আকৃতির জন্য দায়ী প্রাগৈতিহাসিক বন্যা। হ্যাঁ, অবাক লাগলেও এমনটাই সত্যি। সম্প্রতি, ভূতাত্ত্বিকদের গবেষণায় উঠে এল এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ফিরে যেতে হবে প্রায় ২০ হাজার বছর। হিমযুগের শেষ দিক সেটা। ক্রমশ পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গলন শুরু হয়েছিল প্রাচীন হিমবাহগুলির। দৈত্যাকার সেইসব হিমবাহের গলনেই ভয়ঙ্করভাবে প্লাবিত হয়েছিল গোটা পৃথিবী। জন্ম নিয়েছিল মেগাফ্লাড।
আজ-কালকার বন্যার থেকেও যার ভয়াবহতা ছিল কয়েক গুণ বেশি। এই বন্যাই পৃথিবীর ভূত্বকের আকার ও আকৃতি বদলে দেয়।
হিমযুগে পৃথিবীর গোটা ভূপৃষ্ঠ বরফের স্তরে আচ্ছাদিত থাকায়, সুষম চাপ পড়ত সর্বত্র। তবে বরফের গলন শুরু হওয়ার পরেই ধীরে ধীরে গতিশীল হয় হিমবাহগুলি। বন্যার সৃষ্টির সঙ্গে, হিমবাহের এই গতিই দায়ী ছিল ভূত্বকের আকার পরিবর্তনের জন্য।
ভূ-ত্বকের ক্ষয়ে একদিকে যেমন পৃথিবীর বুকে প্রকাণ্ড গিরিখাত, উপত্যকা, স্ক্যাপল্যান্ডের সৃষ্টি হয়; তেমনই ভূপৃষ্ঠের ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে চাপের তারতম্য দেখা দেয়। তার ফলে, টেকটোনিক পাতের গতিতেও বদল আসে।
অনেকটা বেলুনের মতোই ফুলে যায় পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চল। পরিসংখ্যান বলছে বছরে প্রায় ১০ মিলিমিটার আকার বদলেছিল হিমযুগের প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর ভূত্বক।
যুক্তরাষ্ট্রের চেনি-প্যালুস এবং টেলফোর্ড ক্রাব ক্রিকের আকৃতি দেখে প্রথম প্রাগৈতিহাসিক ঘটনাটির অনুমান করেন মার্কিন গবেষকরা। তারপর তৈরি করা হয় বিশেষ জিআইএ মডেল। সুপার কম্পিউটারে সিমুলেশন তৈরি করে একাধিকভাবে পরীক্ষা করা হয় সংশ্লিষ্ট ঘটনাটিকে। তাতেই স্পষ্ট ফুটে ওঠে এই ঘটনার বিবরণ।
হিমযুগের মতো আজকের পৃথিবীও শিকার তাপমাত্রা বৃদ্ধির। গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে ক্রমশ উষ্ণতা বাড়ছে পৃথিবীর। দ্রুত গতিতে গলছে পৃথিবীর বরফ ও হিমবাহগুলি। এই অনিয়ন্ত্রিত বরফের গলনও প্রাগৈতিহাসিক যুগের মেগাফ্লাডকে ফিরিয়ে আনতে পারে, সে-ব্যাপারে সতর্ক করছেন গবেষকরা।
এসডব্লিউ/এসএস/২০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ