যুদ্ধের তীব্র সময়টা পেরিয়ে এসেছে সিরিয়া। ধীরে হলেও শান্তি আর স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সিরিয়ার সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন। কিন্তু পশ্চিমা বা আরব দেশগুলোর সক্ষমতা নেই তাদের সাহায্য করার। সেখানে বরং এগিয়ে এসেছে চীন। প্রাচীন সিল্ক রোড নতুন করে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চলছে।
সিরিয়ায় এক দশক ধরে যুদ্ধ চলছে। এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি সেটা। যুদ্ধে প্রধান তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার। তেলের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটা পূরণে এগিয়ে এসেছে ইরান। লেবানন আর ইরাক থেকেও পাচার হয়ে আসছে কিছু তেল। কিন্তু ইরানে তেলের দর পড়ে গেছে। তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বেড়েছে। আর বিভিন্ন সামরিক চাপ তো আছেই। সব মিলিয়ে ইরান ঠিক মতো তেল সরবরাহ করতে পারছে না।
সিরিয়ার অর্থনীতির জন্য আরেকটি আঘাত হয়েছে লেবাননের আর্থিক সংকট। লেবাননের ব্যাংকগুলোতে যে পুঁজি জমা আছে, তার প্রায় চার ভাগের একভাগই হলো বিভিন্ন সিরীয় কোম্পানির। এর মধ্যে সরকার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিও রয়েছে। লেবানন মুদ্রার ওপর নানান বিধিনিষেধ আরোপ রয়েছে। জরুরি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধে তাই সময় লাগছে। এই সব পণ্যের মধ্যে গমও রয়েছে। সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দামও তাই বেড়ে গেছে গমের।
সিরিয়া তাদের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে জন্য চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। কিন্তু এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে অন্যান্য দেশের মতো একটি ভয়ঙ্কর ঋণের ফাঁদে নিয়ে যেতে পারে বলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
টাইমস অব ইসরায়েলের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএনআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিরিয়া নিজেদের হতাশা থেকে চীনের কাছে তহবিল চাইছে। যাতে করে তাদের অর্থনীতির ক্রমাগত এবং তীক্ষ্ণ পতনকে ফিরিয়ে আনা যায়। ২০১১ সাল থেকে চলমান যুদ্ধের কারণে তাদের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
চীন সরকার সব সময় সিরিয় ইস্যুতে শক্তি প্রয়োগের জোরালো বিরোধীতা করেছে। অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে তারা। সিরিয়া পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চীন সিল্ক রোড উন্নয়নের কথা বলছে। সিরিয়া সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সিল্ক রোড উন্নয়নের মাধ্যমে যদি যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজ হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক বহু এগিয়ে যাবে।
চীন আর সিরিয়ার বন্ধুত্বের ঐতিহ্য অবশ্য দীর্ঘ। প্রাচীন সিল্ক রোডটি দুই দেশের সম্পর্কের প্রতীক হয়ে আছে। পিপলস রিপাবলিকান অব চীন গঠনের পর প্রথম যে আরব দেশগুলো স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার মধ্যে সিরিয়াও ছিল। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও এগিয়ে ছিল দামেস্ক।
২০১১ সালে যখন সিরিয়া সঙ্কটে পড়ে, চীন সরকার তখন জাতিসংঘ সনদ আর আন্তর্জাতিক আইন মেনে সঙ্কট মোকাবেলার কথা বলেছিল। সামরিক সমাধানের তারা তীব্র বিরোধীতা করেছিল। এর একটা কারণ হলো, সামরিক অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সিল্ক রোড ভেঙে দেওয়া।
২০১৮ সালে চীন-সিরিয়ার সম্পর্কের লক্ষ্য বদলে যায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মোকাবেলা থেকে পুনর্গঠনের দিকে নজর সরায় তারা। চীন সরকার নিজেরাই সিরিয়াকে জানায়, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে তারা অংশ নিতে চায়। এর মাধ্যমে সিল্ক রোডের পুরনো দিন তারা ফিরিয়ে আনতে চায়।
পশ্চিমা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলো সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বহুপাক্ষিক শান্তি প্রক্রিয়াতেও তারা অংশ নেয়। পাশাপাশি সিরিয়ার জনগণের জন্য বড় অঙ্কের ফ্রি মানবিক সহায়তাও পাঠায় চীন।
সিরিয়ায় সিল্ক রোডের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি ও শিল্প সহযোগিতা, এবং সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে চায় চীন। একই সাথে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অনিশ্চয়তার ঝুঁকির দিকগুলোতেও নজর দেওয়া দরকার তাদের।
তবে চীনের সঙ্গে হাত মেলানো সিরিয়ার জন্য ঝুঁকি নিয়ে আসবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ, বেইজিংয়ের প্রতিশ্রুতি বড় তা ঠিক আছে। কিন্তু তাদের অর্থায়ন এবং বাস্তবায়ন ধীরগতির। দামেস্কের হতাশাকে উৎসাহিত করছে চীন। এটি মধ্যপ্রাচ্যে চীনের পদচিহ্ন বাড়ানোরও একটি সুযোগ।
সিরিয়া চীনের রাডারের অধীনে রয়েছে। কারণ, সিরিয়া ভূমধ্যসাগরের একটি করিডোরকে প্রতিনিধিত্ব করে। যা সুয়েজ খালকে বাইপাস করে এবং চীনকে আফ্রিকা ও ইউরোপীয় মহাদেশের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ