অং সান সু চি ও তার সরকারের সঙ্গে উত্তেজনা চলছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর, এর ফলে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারির সকালে মিয়ানমারে একটি সেনা অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২০২০ সালের ৮ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি ৮৩ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। ২০১১ সালে সেনা শাসনের অবসানের পর এটি ছিল দ্বিতীয় দফা নির্বাচন। তবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তোলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সংকটের শুরুটা মূলত এখান থেকেই।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত ও ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকে মিয়ানমারে অস্থিতিশীলতা জারি রয়েছে।এই ঘটনার পর দেশটিতে তীব্র গণ-আন্দোলন শুরু হয় এবং সামরিক ক্ষমতার জোরেই বার্মিজ সেনাবাহিনী তা দমনের চেষ্টা করে। এতে নিহত হচ্ছে শিশু নারীসহ অনেক বেসামরিক মানুষ। এবার এক রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ক্ষমতা দখলের বছর খানেকের মধ্যেই অন্তত সাড়ে ৪ হাজার বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে জান্তা সেনা।
এক রিপোর্টে ‘রেডিও ফ্রি এশিয়া’ দাবি করেছে, গত একবছরে বিক্ষোভ দমনের নামে সাধারণ মানুষের ৪ হাজার ৫০০টি বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বার্মিজ সেনা।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাগাইং প্রদেশে ২ হাজার ৫৬৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে সেনা। চীন ও মাগওয়ে প্রদেশে যথাক্রমে ৯৭৬ ও ৬২৬টি বাড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। কায়াহ, মান্দালয়-সহ একাধিক জায়গায় একই ঘটনা ঘটেছে। ওই সমস্ত জায়গায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে স্থানীয় মিলিশিয়াগুলি। ফলে প্রতিশোধ নিতেই এহেন কাজ করেছে বার্মিজ ফৌজ।
সাগাইং প্রদেশে ২ হাজার ৫৬৭টি বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে সেনা। চীন ও মাগওয়ে প্রদেশে যথাক্রমে ৯৭৬ ও ৬২৬টি বাড়ি ভেঙে দেয়া হয়েছে। কায়াহ, মান্দালয়-সহ একাধিক জায়গায় একই ঘটনা ঘটেছে। ওই সমস্ত জায়গায় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছে স্থানীয় মিলিশিয়াগুলি। ফলে প্রতিশোধ নিতেই এহেন কাজ করেছে বার্মিজ ফৌজ।
এদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী বেসামরিক মানুষ খুন করেছে, মানব ঢাল হিসেবেও তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। পূর্বাঞ্চলীয় কারেন্নি রাজ্যে সেনাবাহিনীর এসব ধারাবাহিক সহিংসতা যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা যেতে পারে বলে জানিয়েছে প্রখ্যাত মানবাধিকার গ্রুপ ফোর্টিফাই রাইটস। মিয়ানমারভিত্তিক মানবাধিকার গ্রুপটির নতুন এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
সংগঠনটি জানিয়েছে যে, গত প্রায় আট মাসে গির্জা, আবাসিক ঘরবাড়ি ও বাস্তুচ্যুতদের শিবিরের বেসামরিক নাগরিকদের উপর সেনাবাহিনী হামলা চালায়। এসব হামলায় নিহত হয়েছে অন্তত ৬১ জন।
ফোর্টিফাই রাইটস বলছে, মিয়ানমারের ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞায় আসিয়ানের সমর্থন দেওয়ার এখনই সময়।
ফোর্টিফাই রাইটস এর আঞ্চলিক পরিচালক ইসমাইল ওলফ বলেন, ‘বিশ্ব বাজারে উৎপাদিত অস্ত্র দিয়ে মানুষ খুন করছে মিয়ানমার জান্তা আর সেটা অবশ্যই থামাতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘বেসামরিক মানুষের ওপর আক্রমণ চালানোর আগে মিয়ানমার জান্তাকে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করতে স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ প্রয়োজন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে অবশ্যই মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জরুরিভাবে আরোপ করতে হবে আর আসিয়ানের জন্য কৌশলগত ও দায়িত্ববান অবস্থান হবে এতে সমর্থন দেওয়া।’
দীর্ঘ কয়েক দশক সামরিক শাসনাধীনে থাকার পর ২০০৮ সালের সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে জাতীয় নির্বাচন শুরু হয় মিয়ানমারে। সংশোধিত সংবিধানে দেশটির পার্লামেন্টের মোট আসনের ২৫ শতাংশ ও দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৩টি মন্ত্রণালয় সামরিক বাহনীর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
কিন্তু ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি নেতৃত্বাধীন দেশটির রাজনৈতিক দল এনএলডির বিপুল বিজয় সাংবিধানিক সেই হিসাব ওলট-পালট করে দেয়। বিশাল সেই জয়ে জাতীয় পার্লামেন্টের ৮৩ শতাংশ আসনে এনএলডি প্রার্থীরা বিজয়ী হন।
ফলে, নির্বাচনের পর বেসামরিক প্রশাসনের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রশ্নে অস্বস্তি শুরু হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে। এর প্রেক্ষিতেই নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ভোটার তালিকা প্রকাশে নির্বাচন কমিশন বরাবর দাবি জানায় সেনাবাহিনী। তারপর গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।
এদিকে মিয়ানমারে জরুরি অবস্থার মেয়াদ ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়েছে ক্ষমতা দখলকারী সামরিক বাহিনী। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন চ্যানেল এমআরটিভিতে দেওয়া এক ভাষণে জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লেইং এ সম্পর্কে বলেন, ‘সহিংসতা ও সংঘাত দূর না হলে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কায়াহ, শিন, সাগাইংসহ দেশের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চলে এখনও সহিংসতা চলছে। আমরা সেইসব অঞ্চলের সংঘাত নিয়ন্ত্রণে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করছি।’
ঠিক এক বছর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তারপর থেকেই সেনাঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে মিয়ানমারে টানা বিক্ষোভ চলছে।
সহিংসতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি যেভাবে বাড়ছে এবং বিরোধীরা যেভাবে সমন্বিত হামলা করছে তাতে এই সংঘাত ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
বিবিসি জানায়, সংঘাতের উপর নজরদারি এবং তথ্য সংগ্রহাক প্রতিষ্ঠান অ্যাকলেড (আর্মড কনফ্লিক্ট লোকেশন অ্যান্ড ইভেন্ট ডেটা প্রজেক্ট) এর তথ্যানুযায়ী, মিয়ানমার জুড়েই এখন সংঘাত ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় নানা মাধ্যম থেকে পাওয়া খবরও বলছে, লড়াই করা দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় বেড়েছে এবং তারা একজোট হয়ে লড়ছে। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সশস্ত্র লড়াই এখন শহর এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়েছে, আগে এমনটা দেখা যেত না।
বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসনের অধীনে থাকার অভিজ্ঞতা মিয়ানমারবাসীর রয়েছে। তবে গত এক বছরের জান্তা শাসনে দেশটিতে রক্ত ঝরেছে প্রচুর। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তাবিরোধী তুমুল বিক্ষোভ, বিশেষত তরুণদের প্রতিবাদ, রক্তপাত মিয়ানমারকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেকে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন।
দেশটির একটি মানবাধিকার সংগঠনের বরাতে বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মিয়ানমারে গত এক বছরের সংঘাতে ১ হাজার ৫০০ জনের বেশি বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই জান্তাবিরোধী। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলি–হামলায় তারা প্রাণ হারান। এক বছরে দেশটিতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১১ হাজারের বেশি বেসামরিক মানুষ। আর জান্তার হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মিয়ানমারে ১৬৮ সেনা ও পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মিয়ানমারের এখনকার পরিস্থিতি গৃহযুদ্ধে রূপ নিচ্ছে। সংঘাতকবলিত দেশটিতে শান্তি ফেরাতে ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে এবং কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি সতর্ক করে বলেন, মিয়ানমারের সংঘাতময় পরিস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
আপনার মতামত জানানঃ