মেক্সিকোতে প্রবেশ করতে দেওয়ার দাবিতে দেশটির সীমান্তে অনশন কর্মসূচি পালন করছেন একজন অভিবাসী। প্রতিবাদের অংশ হিসেবে তাকে নিজের ঠোট সেলাই করতেও দেখা যায়। ১৫ ফেব্রুয়ারি তোলা এই ছবিটি প্রকাশ করেছে রয়টার্স
মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছাতে নিজেদের মুখ সেলাই করছেন অভিবাসীরা। মুখ সেলাই করা এসব অভিবাসীর সংখ্যা এক ডজন।
নথিপত্রহীন এসব অভিবাসী মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তে অবস্থান করছেন এবং মেক্সিকো হয়ে মার্কিন সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছাতে উত্তর আমেরিকার এই দেশটির অভিবাসন কর্তৃপক্ষের অনুমতি আদায়ে ব্যতিক্রমী এই প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন।
মেক্সিকো সীমান্তে অবস্থান করে মুখ সেলাই করা অভিবাসীদের অনেকের ছবি সংবাদমাধ্যমে এসেছে। বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থাটি জানিয়েছে, মেক্সিকো সীমান্তে অবস্থান করা এসব অভিবাসীর বেশিরভাগই মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের। সুঁচ ও প্লাস্টিকের সুতো ব্যবহার করে তারা একে অপরের মুখ সেলাই করতে সহায়তা করছেন।
রয়টার্সের প্রকাশিত ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ঠোট সেলাই করা হলেও তরল জাতীয় খাবার খাওয়ার জন্য মুখ একটু ফাঁকা রাখা হচ্ছে এবং সেলাইয়ের সময় রক্ত বন্ধ করতে অ্যালকোহল ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে।
ইরিনিও মুজিকা নামে প্রতিবাদে অংশ নেওয়া এক কর্মী বলছেন, ‘প্রতিবাদের অংশ হিসেবে নিজেদের দু’টি ঠোট একসঙ্গে সেলাই করছেন অভিবাসীরা। অভিবাসীরাও মানুষ এবং তাদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে। আমরা আশা করি, জাতীয় অভিবাসন ইনস্টিটিউট এই বিষয়টি দেখতে পাবে।’
গুয়েতেমালার সীমান্তবর্তী তাপাচুলা শহরের এই নাটকীয় প্রতিবাদে অংশ নেওয়াদের অনেকে তাদের সন্তানদেরও সঙ্গে রেখেছেন। গুয়েতেমালার এই শহরটি মাসের পর মাস ধরে হাজারও অভিবাসীতে পূর্ণ থাকে এবং বৈধ ভাবে সীমান্ত পার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে পেতে অভিবাসীরা সেখানে অপেক্ষা করেন।
ইয়োরজেলিস রিভেরা নামে ভেনেজুয়েলার এক নারী বলেন, ‘আমি আমার মেয়ের জন্য এটি করছি। সে গত কয়েক ঘণ্টা ধরে কিছুই খায়নি এবং …কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আমরা কোনো সমাধানমূলক উদ্যোগও দেখতে পারছি না।’
রিভেরা আরও বলেন, আমরা এখানে বন্দির মতো অবস্থান করছি। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে মেক্সিকোর অভিবাসন বিষয়ক সংস্থা আইএনএম’র কাছ থেকে উত্তরের জন্য আমি এখানে অপেক্ষা করছি।
সীমান্তে আটকে থাকা এসব অভিবাসীদের ব্যতিক্রমী এই প্রতিবাদ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি মেক্সিকোর অভিবাসন কর্তৃপক্ষ। তবে তারা জানিয়েছে, মেক্সিকোর দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরে অবস্থিত তাদের দফতরে প্রতিদিন এ বিষয়ক শতাধিক আবেদন জমা পড়ছে।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর মধ্য আমেরিকা থেকে লাখ লাখ অভিবাসনপ্রত্যাশী যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে অনেকে পায়ে হেঁটে আবার অনেকে ‘ক্যারাভ্যান’ নামে পরিচিত বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ হয়ে মেক্সিকোর ভেতর দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছান।
অভিবাসীদের ক্রমবর্ধমান চাপ সামলাতে কার্যত সংগ্রাম করছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। নিজ নিজ ভূখণ্ড থেকে মেক্সিকো পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে পৌঁছানোই এসব অভিবাসীর লক্ষ্য। অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব মানুষের দাবি, অত্যাচার, সহিংসতা ও দারিদ্র্যতার কারণে তারা মাতৃভূমি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যেতে চান।
রয়টার্স বলছে, সহিংসতা ও দারিদ্র্যতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার উদ্দেশে মেক্সিকোতে পৌঁছানো মানুষের সংখ্যা সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়েছে। ২০২১ সালে উত্তর আমেরিকার এই দেশটিতে আশ্রয় চাওয়া মানুষের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে ৮৭ শতাংশ। আশ্রয়প্রার্থী এসব মানুষের বেশিরভাগই হাইতি ও হন্ডুরাসের বাসিন্দা।
এর আগে গত বছর শুরুতে গুয়েতেমালা সীমান্তে যুক্তরাষ্ট্র অভিমুখী হন্ডুরাসের হাজার হাজার অভিবাসী অবৈধভাবে প্রবেশের চেষ্টা করে। তারা পায়ে হেঁটে মেক্সিকো হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর আশায় নিজ দেশ ত্যাগ করেন। তবে সে সময় গুয়েতেমালা সরকার অবৈধভাবে অভিবাসীদের প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপ করেন। দেশটি সীমান্তে অবৈধ প্রবেশ ঠেকাতে বিপুল সংখ্যক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭ জানুয়ারি অন্তত সাত হাজার অভিবাসী গুয়েতেমালার ভাদো হোন্ডো গ্রামের সীমান্তে পৌঁছায়। তারা সীমান্ত অতিক্রম করার চেষ্টা করলে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। এসময় অনেক অভিবাসী নিরাপত্তা বলয় টপকে সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে।
কেন বারবার একই পরিস্থিতি বারবার তৈরি হচ্ছে? এ প্রসঙ্গে বেশিরভাগ অভিবাসী বলছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্র বা মেক্সিকোয় নতুন জীবন এবং উন্নত সুযোগের আশা করছেন।
অন্যরা বলছেন, নিজ দেশের সহিংসতা থেকে বাঁচার জন্য তারা পালিয়ে এসেছেন এবং নতুন দেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় চাইবেন। যেমন হন্ডুরাসে অপরাধী চক্রের সহিংসতা, মাদক যুদ্ধ এবং দুর্নীতি বড় ধরণের সমস্যা। পুরো অঞ্চলটিতে বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় একটি সংবাদপত্র এল হেরাল্ডোকে দুই সন্তানের এক মা বলেন, আমাদের স্বপ্ন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া, কারণ আমরা আমাদের সন্তানদের একটি উন্নত ভবিষ্যৎ দিতে চাই। এখানে (হন্ডুরাসে) আমরা কোন কাজ পাইনা’।
যদিও মধ্য আমেরিকান দেশগুলো থেকে অনেক দিন ধরেই অনেক মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে যাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু এভাবে সংগঠিত অভিবাসী স্রোতের ব্যাপারটা একেবারেই নতুন। অনেক সময় এই অভিবাসীদের মানব পাচারকারী এবং মাদক ব্যবসায়ীরা অপহরণ করে নিজেদের জন্য কাজ করতে বাধ্য করে। তবে এ ধরণের বিশাল গ্রুপকে লক্ষ্যবস্তু করা কঠিন। ফলে তারা অধিক নিরাপত্তা বোধ করেন।
এসডব্লিউ/এসএস/১১৪০
আপনার মতামত জানানঃ