ভারতবর্ষ এক বিচিত্র দেশ। গঙ্গা দিয়ে যত পানি গড়িয়েছে, বৈচিত্র্যে এবং ইতিহাসে ততই মিলে মিশে গেছে এই দেশ। সেই কবে থেকে সভ্যতার উদযাপন চলছে এখানে। তৈরি হয়েছে একের পর এক স্থাপত্য। তৈরি হয়েছে বহু মন্দির, দেবালয়।
কিন্তু সেইসব কিছু কি এখনও রয়েছে, একইভাবে? না। ভারতের ইতিহাস যেমন স্থাপত্য গড়ার ইতিহাস, তেমনই স্থাপত্য ধ্বংসেরও।
ধর্মীয়, রাজনৈতিক কারণে একসময় বহু স্থাপত্য ধ্বংস করা হয়েছে। প্রচলিত কথা অনুযায়ী, মুসলিম শাসকরা যখনই মসনদে বসেছেন, তখনই ইচ্ছামত ভেঙে ফেলেছেন মন্দির।
একেবারে মিথ্যেও নয় সেটা। মুসলিম শাসকদের মন্দির ভাঙার যাবতীয় কাহিনি সেই কবে থেকে আমরা পড়ে আসছি। কালাপাহাড় থেকে মহম্মদ ঘোরী, আওরঙ্গজেব; সবাই কুখ্যাত হয়ে আছেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়েরও ধ্বংস বখতিয়ায়র খিলজির হাত ধরে।
ভারতের মন্দির ধ্বংসের বিষয়ে প্রচলিত মিথই হচ্ছে মুসলমান শাসকেরা এই মন্দিরসমুহ ভেঙ্গেছেন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ রিচার্ড এম ইটন জানাচ্ছে; ১২ শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত, দক্ষিন এশিয়ায় মুসলমান শাসকদের হাতে মোট ৮০ টি মন্দির ভাঙা হয়েছিল। মন্দিরগুলো কেন ভাঙা হয়েছিল সেটার কারণও অনুসন্ধান করেছন রিচার্ড ইটন।
যেই সমস্ত রাজা মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং সেই বিদ্রোহে যদি কোন মন্দির বিদ্রোহী রাজার সাথে পলিটিক্যালি যুক্ত থাকতো সেই মন্দির মুসলমান শাসকেরা ধ্বংস করেছে। অর্থাৎ কারণটা পুরোপুরি রাজনৈতিক; ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়।
সম্রাট আওরঙ্গজেব সম্পর্কেও মন্দির ধংসের অপবাদ শোনা যায়। এখানেও বিস্ময়কর ভাবে কারণটা রাজনৈতিক। আওরঙ্গজেব রাজপুতদের মন্দির ভেঙেছিলেন, যেই রাজপুত মোঘলদের অনুগত ছিল কিন্তু আওরঙ্গজেবের আনুগত্য মানতে অস্বীকার করে বিদ্রোহ করে। সেই বিদ্রোহ দমনের পরে মন্দিরগুলো ভাঙা হয়।
এখানে সবচেয়ে কৌতূহল উদ্দীপক তথ্য দিয়েছেন ইটন বাংলা সম্পর্কে। আর তা হলো বাঙলায় সম্রাট আওরঙ্গজেব যে কোন মোঘল শাসকদের চেয়ে বেশী মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেবের অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু হিন্দু বিদ্বেষের দোষটা আরোপিত যেটা তার প্রাপ্য নয়।
তবে কেবলমাত্র মুসলমানরাই এই ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, সেই ধারণাও একেবারে ভুল। খোঁজ করলে দেখা যাবে, অনেক হিন্দু রাজাও মন্দির, মঠ, স্থাপত্য ভেঙে ফেলেছেন। শুধু ভেঙে ফেলাই নয়, সেখানকার অধিবাসীদেরও হত্যা করেছেন।
হিন্দু রাজার বিরুদ্ধেও বৌদ্ধ ও জৈনদের উৎপীড়ন এবং তাদের ধর্মস্থান ধ্বংস করার অভিযোগ রয়েছে। গৌড়ের শাসক শশাঙ্কের কথা আমরা সকলেই পড়েছি। ঠিক তেমনই ইতিহাসবিদরা তার বৌদ্ধ-বিদ্বেষের কথাও বলেন। তার রাজত্বকালে বহু বৌদ্ধ মঠ ভেঙে ফেলেন তিনি।
শুধু তাই নয়, তার নির্দেশে বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুককে হত্যা করা হয়। বঙ্গ থেকে বৌদ্ধ ধর্মকে সমূলে উৎখাত করাই তার অন্যতম চিন্তা ছিল।
একা শশাঙ্কই নয়, সুলতান মহমুদ এবং মোহাম্মদ ঘোরির মধ্যবর্তী সময়ের মানুষ কাশ্মীররাজ হর্ষও ধ্বংস করেছেন মন্দির। ১০৮৯ থেকে ১১০১ সাল অব্দি তার রাজত্বকাল। শুধু যে সুদর্শন ও শৌখিন মানুষ ছিল তা-ই নয়, তার আরও অনেক গুণ ছিল। সঙ্গীত ও শিল্পরসিক, স্বয়ং কবি ও বহুভাষাবিদ। শুরুতে কৃতিত্বের সঙ্গেই রাজত্ব চালিয়েছেন। কিন্তু তারপর নানা বিতর্ক, ভুলভ্রান্তি এবং কুকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তার পরিণতিও ছিল খুব করুণ।
লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি বইয়ের আলোচনা প্রসঙ্গে হর্ষ সম্পর্কে উইলিয়াম ডালরিমপল-এর মন্তব্য, ‘শুধু এই কাশ্মীরি রাজা একাই অন্তত চার হাজার বৌদ্ধ পূণ্যস্থান ধ্বংস করার জন্য দায়ী।’
কাশ্মীরের ইতিহাসকার কলহনের পিতা চম্পক ছিল হর্ষের মন্ত্রী। কলহন তার ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপাদানসমৃদ্ধ বই রাজতরঙ্গিনী’তে হর্ষ সম্পর্কে লিখেছেন, শুধু বৌদ্ধ ধর্মীয় ইমারতই নয়, কোনো গ্রাম নগর বা শহরে এমন একটা মন্দির অবশিষ্ট ছিল না যার বিগ্রহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি তুরস্ক রাজা হর্ষ দ্বারা। মন্দির আক্রমণকারী বলেই হয়তো কলহন তাকে তুরস্ক আখ্যা দিয়েছিলেন।
শুধু যে মন্দির আক্রমন করতেন তা নয়, বিগ্রহও উঠিয়ে নিয়ে যেতেন। এই ধ্বংসাত্মক কাজ পরিচালনার জন্য বিশেষ কর্মচারীও ছিল তার। পদটার নাম দিয়েছিলেন দেবোৎপাটননায়ক। তারা বিগ্রহ নিয়ে যেসব জঘন্য কান্ড করত তা কোন মুসলমান শাসক বা রাজকর্মচারীরাও ভাবতে পারেনি। কলহনই লিখে গেয়েছেন এসব।
তবে হর্ষ একা নন, ধর্মস্থান লুট এবং ধ্বংস করার জন্য হিন্দু রাজাদের মধ্যে দায়ী আরও কেউ কেউ। রাজপুত পারমার বংশের শাসক সুভাতবর্মন গুজরাট আক্রমনকালে দাভোই এবং ক্যাম্বে-র বহু জৈন মন্দির লুট করেছে। শৈবদের হাতেও বহু বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের ক্ষতি হয় বা সেগুলো পরে শিব মন্দিরে রূপান্তরিত হয়েছে।
১০ ও ১১ শতকের চোল বংশের শৈব সম্রাট প্রথম রাজারাজা চোল এবং তার পৌত্র রাজাধিরাজ চোল-এর বিরুদ্ধেও ইতিহাসে অভিযোগ চালুক্য রাজ্যের জৈন মন্দির লুণ্ঠন ও ধ্বংসের। ৬ শতকের আর এক শৈব শাসক মিহিরকুল বৌদ্ধ বিহার ও স্তুপ ধ্বংস এবং বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।
কথায় বলে, ইতিহাস আমাদের অতীতকে চিনতে, জানতে শেখায়। খড়ের গাদার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে কত না অজানা তথ্য। কিন্তু সেই ইতিহাসই আমাদের কাছে উঠে আসে একমুখী হয়ে।
মুসলিম শাসকদের ধ্বংসলীলার সত্যতার পিছনে বাকিদের কথাও চাপা পড়ে যায়। অথচ তারাও সমানভাবে দোষী। আসলে এই সন্ত্রাস কখনও ধর্ম দেখে হয় না।
এসডব্লিউ/এসএস/২১৫০
আপনার মতামত জানানঃ