সৌদি বাদশাহ সালমান ভাতিজা মুহাম্মদ বিন নায়েফকে সরিয়ে সিংহাসনের উত্তরসূরি করেন ছেলে মুহাম্মদ বিন সালমানকে। এরপর থেকে বদলের হাওয়া বইতে শুরু করে রক্ষণশীল দেশ বলে পরিচিত সৌদি আরবে। দেশটি অর্থনৈতিক সংস্কারের নামে তেলভিত্তিক অর্থনীতির ওপর নির্ভরতা কমানো, পর্যটন ও শিল্পায়নে গুরুত্ব দেওয়া, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি আর নারীদের অধিকারের বিষয়ে ধাপে ধাপে অনেকটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যার মূল কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানকে। বাবা বাদশাহ সালমান সিংহাসনে থাকলেও কার্যত অনেক ক্ষেত্রেই মূল ভূমিকা পালন করছেন এই যুবরাজ।
মদিনাকে কীভাবে একটি ভবিষ্যতের শহর হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করতে এ সপ্তাহে শহরটিতে জড়ো হয়েছেন স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, ব্যবসায়ী ও নেতারা। খবর আরব নিউজ।
৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘স্মার্ট মদিনা ফোরাম’ নামের দুই দিনব্যাপী সম্মেলনটি হয়েছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল মদিনাকে সৌদি আরবের শীর্ষ তিনটি বাসযোগ্য শহরের মধ্যে একটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভাব্য উপায়গুলো খুঁজে বের করা।
সম্মেলনে যেসব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আলোচিত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— শহরের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ বাড়ানো এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বেকারত্বের হার ৫ শতাংশ কমানো।
এছাড়া শহরে প্রযুক্তিগত কিছু পরিবর্তন আনার ব্যাপারেও গুরুত্বারোপ করা হয় এ ফোরামে। যেমন, ফাইভজি ও ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক তৈরি, উন্নত যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামো নির্মাণ এবং সকল ক্ষেত্রে স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হয়।
তিনটি প্যানেল আলোচনা এবং ১২ জন বিখ্যাত বক্তার উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয় এই ফোরামে। বক্তারা মদিনাকে একটি স্মার্ট শহর হিসেবে গড়ে তুলতে ছয়টি খাতের উপর প্রাধান্য দেওয়ার কথা বলেছেন। সেগুলো হচ্ছে: পর্যটন, পরিবেশ, ব্যবসা, পুরানো অঞ্চল, জনকল্যাণ ও গতিশীলতা।
ফোরামে হওয়া ছয়টি কর্মশালায় মোট ১৪৮ জন অংশ নিয়েছেন। কর্মশালাগুলো থেকে প্রায় পাঁচ শতাধিক নতুন আইডিয়া বের হয়েছে। এসব আইডিয়ার উপর ভিত্তি করে প্রতিটি সেক্টরে উন্নয়নের কেস স্টাডি করা হবে।
আল-মদিনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান তথ্য বিশ্লেষক ও উদ্ভাবন কর্মকর্তা আব্দুর রহমান ইব্রাহিম বলেন, ‘স্মার্ট মদিনা প্রোগ্রামের কৌশল এবং লক্ষ্যগুলো অত্যন্ত মানবকেন্দ্রিক। নাগরিক চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে সঠিক প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে এখানে’।
‘স্মার্ট মদিনা প্রোগ্রামের কৌশল এবং লক্ষ্যগুলো অত্যন্ত মানবকেন্দ্রিক। নাগরিক চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করে সঠিক প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হচ্ছে এখানে’।
সারা বিশ্বের মুসলমানদের কাছে মদিনা একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। শহরের যানজট স্থানীয় নাগরিক ও যাত্রীদের একটি প্রধান সমস্যা। স্মার্ট শহর হওয়ার পথে শহরের যানবাহন সমস্যা সমাধান করাকে প্রথমেই অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে জানান ইব্রাহিম।
দ্বিতীয় স্মার্ট মদিনা ফোরাম ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হবে।
ঐতিহ্যগতভাবে রক্ষণশীল ইসলামী দেশ হিসেবেই পরিচিত সৌদি আরব ক্রমেই হাজার বছরের পুরোনো খোলস ছেড়ে ক্রমেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কঠোর ইসলামপন্থী দেশটি ধীরে ধীরে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে শুরু করেছে। আর সেই যাত্রায় একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান।
সৌদির আদি ইসলামী ঐতিহ্যকে ‘কট্টরপন্থা’ আখ্যা দিয়েছেন। বিপরীতে দেশে ‘মধ্যপন্থী ইসলাম’ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন তিনি। কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘মধ্যপন্থা’র নামে তিনি আসলে পশ্চিমা ভাবধারা ও সংস্কৃতিকেই আমদানি করছেন।
বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এখন নামেমাত্র সৌদি শাসক। প্রকৃত শাসন ক্ষমতা মোহাম্মদের হাতেই। ২০১৭ সালে ছেলেকে ক্রাউন প্রিন্স বা যুবরাজ ঘোষণা করেন বাদশাহ। সরিয়ে দেন ভাতিজাকে। ভবিষ্যৎ বাদশাহির পথ সুগম হওয়ায় পর্দার আড়াল থেকে সামনে চলে আসেন প্রিন্স সালমান।
সমাজ ও সংস্কৃতির ‘আধুনিকায়নে’ ভিশন-২০৩০ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। সেই লক্ষ্যেই ইতিমধ্যে বহু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। গাড়ি চালানো, হলে গিয়ে সিনেমা ও মাঠে গিয়ে খেলা দেখা এমনকি অভিভাবক ছাড়াই নারীদের হোটেলে কক্ষ ভাড়া নেয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি দেশটির বিভিন্ন বড় কনসার্টেরও আয়োজন করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়, যা নিয়ে সারাবিশ্বে সমালোচনা চলছে।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে বিনোদন শিল্পের। সদ্যই সৌদি আরবের সংগীত উৎসব ‘সাউন্ডস্টর্ম সংগীত উৎসব’ শেষ হলো। চারদিনের সংগীত উৎসবে সাত লাখের বেশি অতিথি অংশগ্রহণ করেছে। এর রেশ যেতে না যেতেই সৌদিবাসীর জন্য ‘নিউ ইয়ার’ এসেছিল বাড়তি আনন্দ হয়ে। বিশ্বের বিভিন্ন জনপদের মতো মহা ধুমধামে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবও। জমকালো আয়োজন আর আতশবাজির রঙিন আলোর ঝলকানিতে ২০২২ সালকে স্বাগত জানিয়েছে সৌদিবাসী।
সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে এবার গুরুত্ব বাড়ছে চলচ্চিত্র শিল্পের। সৌদি আরবে সিনেমা মুক্তিতে ৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা উঠেছে মাত্র ৪ বছর হলো। তবে সংবেদনশীল ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয়, যৌনতা ও সমকামিতা স্পর্শ করে এমন সিনেমা দেশটিতে এখনো নিষিদ্ধ। পশ্চিম এশিয়ার সিনেমাগুলো সবচেয়ে বেশি মুক্তি পায় সেদেশে। বর্তমানে সৌদি আরবে ১৫৪টি সিনেমা হল চালু আছে।
গত শতক পর্যন্ত সৌদির ক্ষমতাসীন আল সৌদ পরিবার অনেকটা নিশ্চিন্তেই শাসনকার্য চালিয়ে গেছে। তাদের মূল ভরসা দেশটির বিপুল তেলসম্পদ। আর রক্ষণশীল ধর্মীয় নেতাদের সমর্থন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। সৌদি আরবকে এখন একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে এখন তরুণদের জয়জয়কার। তাদের অবজ্ঞা করা কোনো শাসকের পক্ষেই সম্ভব না। তরুণদের উপেক্ষার পরিণতিতে মসনদও উল্টে যেতে পারে। সৌদি বাদশা সালমানকে দূরদর্শীই বলতে হয়। তিনি বাস্তবতা বুঝতে পেরেছেন। তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি তার ৩২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ বিন সালমানকে ক্রাউন প্রিন্স করেছেন। সিংহাসনের এই উত্তরাধিকারী এখন সৌদির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রধান সারথি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২৩৪২
আপনার মতামত জানানঃ