লন্ডনভিত্তিক সংস্থা ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ইআইইউ বৃহস্পতিবার গণতন্ত্র সূচক ২০২১ প্রকাশ করেছে৷ গতবারের মতো এবারও ‘হাইব্রিড রেজিম’ তালিকায় আছে বাংলাদেশ৷ তবে সূচকে এক ধাপ এগিয়েছে দেশটি৷
ইআইইউ-এর মতে, ব্যাপক অনিয়মের কারণে বাংলাদেশে নির্বাচন স্বাধীন ও স্বচ্ছ হতে পারছে না, দুর্নীতির বিস্তার বাড়ছে এবং আইনের শাসন এখানে দুর্বল।
১৬৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তিউনিসিয়ার সঙ্গে যৌথভাবে ৭৫তম। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এই বৈশ্বিক সূচক নির্ধারিত হয়েছে পাঁচটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে— নির্বাচন প্রক্রিয়া ও বহুত্ববাদ, সরকার পরিচালনা, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নাগরিক স্বাধীনতা।
সব মিলিয়ে ১০ এর মধ্যে ৫ দশমিক ৯৯ স্কোর পাওয়া বাংলাদেশকে হাইব্রিড রেজিম বা মিশ্র শাসনের শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।
ইআইইউ ২০০৬ সালে যখন প্রথম এই সূচক প্রকাশ করে, তখন ৬ দশমিক ১১ স্কোর নিয়ে চিহ্নিত হয়েছিল ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র হিসেবে। কিন্তু পরের বছরই বাংলাদেশের স্ট্যাটাস মিশ্র শাসনে নেমে যায় এবং তারপর থেকে এই ক্যাটাগরিতেই রয়েছে দেশটি।
২০২১ সালের সূচকে বৈশ্বিক গড় স্কোর ৫ দশমিক ২৮, যা ২০২০ সালের ৫ দশমিক ৩৭ থেকে কম। এক বছরে সবচেয়ে বেশি স্কোর হ্রাসের রেকর্ড এটিই। তাছাড়া ২০০৬ সালে প্রথম এই সূচক প্রকাশের পর থেকে এবারই বৈশ্বিক স্কোর সবচেয়ে কম।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২১ সালে অধিকাংশ দেশেরই গড় স্কোর কমেছে বা আগের জায়গাতেই আটকে রয়েছে। উন্নতি ঘটেছে মাত্র ৪৭টি দেশের (২৮ দশমিক ১ শতাংশ)।
২০২১ সালে যে ৪৬টি দেশের অবস্থান ‘স্থবির’ রয়েছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০২০ সালের তুলনায় এ বছরও এই দেশগুলোর স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে।
১৬৭টি দেশের মধ্যে ৭৪টি দেশের সামগ্রিক স্কোরই ২০২০ সালের তুলনায় কমেছে।
ব্যাপক অনিয়মের কারণে বাংলাদেশে নির্বাচন স্বাধীন ও স্বচ্ছ হতে পারছে না, দুর্নীতির বিস্তার বাড়ছে এবং আইনের শাসন এখানে দুর্বল।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে বিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কার্যকরী ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে সে চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর অনেকে দেশে গণতন্ত্র নামেমাত্র কার্যকর রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর মতো অনেক দেশে সরাসরি সামরিক শাসন না থাকলেও, অনেক দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো সামরিক একনায়কদের মতোই আচরণ করছে বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণে বলা হচ্ছে। আর টক অব দ্য টেবিলে বাংলাদেশের নামটা উঠে আসছে বেশ জোরেশোরেই। গণতান্ত্রিকভাবে স্বৈরতন্ত্রকে প্রতিপালনে রোল মডেল হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটি। আর চালকের আসনে আছে আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারে হত্যা বাড়ছে। বাড়ছে হানাহানি। আর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনাগুলো মূলত ঘটছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে আধিপত্য নিয়ে। নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্বের কারণেও ঘটছে হত্যাকাণ্ড। ঘটছে গুপ্ত হত্যা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের(আসক) হিসাব অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর এই ১০ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭৪জন। এরমধ্যে নির্বাচনী সহিংসতায় মারা গেছেন ৪৩ জন। এরমধ্যে ইউপি নির্বাচনে ৩১ জন। পৌর নির্বাচনে ১০ জন এবং সংসদীয় উপনির্বাচনে সহিংসতায় মারা গেছেন তিন জন।
অবশ্য এর আগের বছর ২০২০ সালে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অনেক কম ছিলো। ওই বছর পুরো ১২ মাসে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩১টি। তার মধ্যে নির্বাচনী সংঘাতে মারা গেছে পাঁচ জন। ওই বছর অল্প কিছু নির্বাচন ও উপনির্বাচন ছিলে। এরমধ্যে উপজেলা নির্বাচনে একজন এবং পৌর ও সিটি নির্বাচনে চার জন নিহত হন।
২০১৯ সালে রাজনৈতি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৯টি। তার মধ্যে বিভিন্ন নির্বাচনে নিহত হয়েছেন ২৫ জন। ২০১৮ সাল ছিলো একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। ওই বছর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৬৯টি। ২০১৭ সালে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড হয়েছে ৫২টি।
আসকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৭ সাল থেকে এপর্যন্ত রাজনৈতিক হত্যা চলতি বছরেই বেশি ঘটেছে। নির্বাচনি খুনও বেশি। আর ১০ মাসেই তা আগের বছরের দুই গুণেরও বেশি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডও এই ১০ মাসেই বেশি।
গত বছরে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বেড়ে যাওয়ার পেছনে দলীয় প্রতীকে ইউপি নির্বাচনকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা। আর এই হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বেশি শিকার হয়েছেন স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। আওয়ামী লীগের হাতেই আওয়ামী লীগের লোকজন বেশি খুন হয়েছে। বিএনপি দলীয়ভাবে নির্বাচনে নেই।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দুই ধাপের ইউপি নির্বাচনে এপর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪৭ জন।
সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ধাপের নির্বাচনে। এই দুই ধাপে যথাক্রমে ৩০ ও ২৬ জন নিহত হয়েছেন। প্রথম ধাপে দুই ভাগে নির্বাচন হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগের নির্বাচন হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। মূলত তখন থেকেই সারা দেশে নির্বাচন ঘিরে সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয়। প্রথম ধাপে ৫ জন, চতুর্থ ধাপে ১০, পঞ্চম ধাপে ২৩ ও ষষ্ঠ ধাপের ইউপি নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় এখন পর্যন্ত একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এ নিয়ে গত ৫ মাসে নির্বাচনী সংঘাত ও হানাহানিতে সারা দেশে ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাধীনতা আমাদের সব আশা পূর্ণ করেনি। দারিদ্র্যকে অনেকটা তাড়িয়েছে। দুর্নীতিকে তাড়াতে পারেনি। দুর্নীতি আরও বড় আকারে দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সন্ত্রাস। ৫০ বছরে আমাদের অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। তার ফসল খেয়ে ফেলছে এ দুর্নীতি ও সন্ত্রাস। আগে যুদ্ধটা ছিল বিদেশি শাসক-শোষকদের বিরুদ্ধে। এখন তাদের স্থান দখল করেছে দেশি শাসক-শোষক। তারা আরও ভয়ংকর।
তারা বলছেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্রের এ পঙ্গুত্ব দূর করার জন্য একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক বিরোধী দল চাই। একটি দল দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকলে তার ভেতর ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা দেখা দেয়। দুর্নীতি জন্ম নেয়। বাংলাদেশে আজ সেই অবস্থা। এ অবস্থা থেকে দেশকে উদ্ধারের একমাত্র পথ গণতন্ত্রের পঙ্গুত্ব দূর করা এবং স্বাধীনতার মূল আদর্শগুলো ধর্মান্ধদের কবল থেকে মুক্ত করা। এ লক্ষ্যের পথে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ধীরে ধীরে চেতনা জাগ্রত হচ্ছে এটাই আশার কথা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭৫১
আপনার মতামত জানানঃ