একটা সময় পৃথিবীর বুকে বিরাজ করত ডাইনোসরেরা। তারপর পৃথিবীতে জন্ম নেয় স্তন্যপায়ীরা। তাদের আয়তনও নেহাত কম ছিল না। আজকের বাঘ, সিংহের চেয়েও বহুগুণ হিংস্র ছিল তাদের স্বভাব। পৃথিবীর বুক থেকে তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে আজও জীবিত রয়েছে তাদের ‘বংশধর’-রা। যদিও বিবর্তনের সূত্র মেনে, কমেছে আয়তন। দেখে নেওয়া যাক এমনই কিছু প্রজাতি ও তাদের পূর্বপুরুষদের।
গালাপাগোস কচ্ছপের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? বর্তমান পৃথিবীর বুকে সর্ববৃহৎ কচ্ছপ প্রজাতি গালাপাগোস। তাদেরই পূর্বপুরুষ ছিল মেগালোচেলিস অ্যাটলাস। তবে প্রাগৈতিহাসিক এই দৈত্যের কাছে গালাপাগোস নিতান্তই শিশু।
অন্ততপক্ষে ২ মিটার দীর্ঘ হত প্রাগৈতিহাসিক এই সরীসৃপ। ওজন হত ২-৩ হাজার কেজি! তৃণভোজী এই কচ্ছপটিও ছিল প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর বৃহত্তম কচ্ছপ। মেগালোচেলিস অবলুপ্ত হয়েছে বহুকাল আগেই, এখন অবলুপ্তির সঙ্গে লড়াই করছে তাদের উত্তরসূরিরাও।
চ্যাপালম্যালানিয়া র্যাকুন। দক্ষিণ আমেরিকার এই প্রাণীটির সঙ্গে ইদানিং সকলেই পরিচিত মার্ভেল সিনেমার দৌলতে। দৈর্ঘ্য গড়ে এক ফুটের কাছাকাছি হয় র্যাকুন। তবে তার পূর্বপুরুষরা লম্বায় হত প্রায় ১.৩ মিটার। উচ্চতা হত ৭০ সেমি পর্যন্ত। ৮০ কেজি ওজনের এই প্রাগৈতিহাসিক জীব খুব একটা শান্তশিষ্ট ছিল না বলেই মনে করেন গবেষকরা।
আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর থেকে হারিয়ে যাওয়া পেলোরোভিস প্রজাতি ছিল মহিষের পূর্বসূরি। আক্ষরিক অর্থেই যা ‘বিস্ট’। দেড় থেকে দু’হাজার কেজি ওজনের এই প্রাণীটির আয়তন ছিল আজকের মহিষের প্রায় দ্বিগুণ। ৪-৫ ফুট প্রশস্ত ছিল তার শিং। আজ এমন দৈত্যাকার প্রাণীর অস্তিত্ব থাকলে, তাকে সমঝে চলত বাঘ-সিংহরাও।
ডাইনো শুনেই ভাবলেন এ বুঝি ডাইনোসরের কোনো বংশধর। না, একেবারেই তেমন নয়। ডাইনোক্রোকুটা আদতে স্তন্যপায়ী প্রাণী। তাদের থেকেই বিবর্তিত হয়েছে হায়নারা।
প্রাগৈতিহাসিক এই প্রাণীটিরও সামনের পায়ের থেকে পেছনের দুটি পা আয়তনে ছোটো হত। তবে দৈর্ঘ্যে (২.২ মিটার), উচ্চতায় (১২০ সেমি) তারা ছিল প্রায় বাঘের সমান। আফ্রিকা এবং এশিয়ায় জীবাশ্ম পাওয়া গেছে এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীটির।
বার্বারোফেলিস; নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এই প্রাণী ছিল ফেলাইন বা বিড়াল গোত্রের। আয়তন হত আজকের সিংহের মতো। তবে ওজন বেশ কয়েকগুণ। তার অন্যতম কারণ শারীরিক গঠনের দৃঢ়তা এবং হাড়ের ঘনত্ব।
এদের উত্তরসূরিদের সঙ্গে খুব একটা পরিচিত নই আমরা কেউ-ই। আজকের পৃথিবীতে মডার্ন ফোসা বা ফেরক্স এদের জিনের বাহক। তবে তাদের আয়তন তুলনামূলকভাবে খুবই ছোটো। ওজন হয় মাত্র ৬-৮ কেজি।
অধুনা ক্যালিফোর্নিয়া এবং ওরেগন সমুদ্রসৈকতে ছিল সামুদ্রিক প্রাণী পোন্টোলিস ম্যাগনাসের বসবাস। সিন্ধুঘোটক বা ওয়ালরাসের পূর্বপুরুষ ছিল পোন্টোলিস।
তবে সিন্ধুঘোটকের মতো ঝুলন্ত বৃহদাকার দাঁত না থাকলেও, আয়তনে দ্বিগুণ প্রাণীগুলির হিংস্রতা কম ছিল না এতটুকু। আজ থেকে আনুমানিক ৫০ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নেয় পোন্টোলিস ম্যাগনাস।
ডায়োডন কথাটার বাংলা অর্থ ‘ভয়াল দাঁত’। আজ থেকে ২-৩ কোটি বছর আগে উত্তর আমেরিকায় বিরাজ করত এ-প্রাণী। ডায়োডন বন্য শূকরের পূর্বপুরুষ। আজও বন্য শূকরের আক্রমণে প্রাণ যায় বহু মানুষের। মুখের দু’পাশে বেরিয়ে থাকা ধারালো দাঁত ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় দেহ। আর তাদের প্রাগৈতিহাসিক পূর্বসূরিরা ছিল আরও ভয়ঙ্কর। ওজন হত হাজার কেজি পর্যন্ত। দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ মিটার।
আজকের দিনে বৃহত্তম পেঙ্গুইন প্রজাতি হিসাবে পরিগণিত হয় এমপেরর পেঙ্গুইন। উচ্চতা হয় প্রায় ১.১ মিটার। তাদের থেকেও প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতা ছিল কলোসাস পেঙ্গুইনের। প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চতা হত অন্তত ২ মিটার। অর্থাৎ, মানুষের থেকেও বেশ খানিকটা লম্বা ছিল এই পেঙ্গুইন। ওজন হত ১১৫ কেজি।
আজ থেকে ৩.৭ কোটি বছর আগেই পৃথিবী থেকে অবলুপ্ত হয়েছে কলোসাস পেঙ্গুইন। এই পেঙ্গুইন ছিল মাংসাশী। ফলে, আজ জীবিত থাকলে এমন পাখির নরখাদক হয়ে উঠতে পারত।
স্যাবার টুথ লেপার্ড; নাম থেকেই বোঝা যায় চিতার এই পূর্বপুরুষরা ছিল ভয়ঙ্কর দাঁতের অধিকারী। মুখের দু’পাশে বেরিয়ে থাকত কয়েক ইঞ্চি লম্বা ক্যানাইন দাঁত। যার কামড় ছাড়ানো মুশকিল যেকোনো প্রাণীর পক্ষেই।
সেইসঙ্গে স্যাবার টুথের আরও একটি বিশেষত্ব ছিল, এদের নিচের চোয়াল ঘুরতে পারত প্রায় ৯০ ডিগ্রি। ফলে, নিজেদের তুলনায় আয়তনে বড়ো কোনো প্রাণীদেরও অনায়াসেই ধরাশায়ী করত স্যাবার টুথ। সেইসঙ্গে দৌড়ানোর অসীম ক্ষমতা তো ছিলই। ২৭০ কেজি ওজনের এই জায়েন্ট ক্যাট ছিল আজকের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের সম আয়তনের।
সাউথ আইল্যান্ড জায়েন্ট মোয়া পেঙ্গুইনের কথা যখন উঠলই, তখন আরও এক পক্ষী প্রজাতির কথাও বলে রাখা যাক। নিউজিল্যান্ডের এই আদি বাসিন্দার উচ্চতা হত প্রায় সাড়ে তিন মিটার। অর্থাৎ, তাকে দুই মানুষ দীর্ঘ ধরতেই পারেন। ওজনও হত ৩৫০ কেজি পর্যন্ত।
আজকের কিউয়ি পাখির পূর্বপুরুষ জায়েন্ট মোয়া। আজ থেকে হাজার চল্লিশেক বছর আগেও এদের অস্তিত্ব ছিল বলে ধারণা গবেষকদের। প্রাচীন মাওরি উপজাতির মানুষদের শিকার হতে হতে হারিয়ে যায় এই প্রজাতি।
তবে খুব কম সংখ্যক প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদেরই অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে বরফের তলায়। বাকিদের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে জীবাশ্ম। প্রকৃতিবিদ রোমান ইউচিটেল সেই জীবাশ্মের বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তৈরি করেছেন সংশ্লিষ্ট প্রাণীদের ছবিগুলো। তার ‘প্রিহিস্টোরিক ফনা’ প্রকল্পের সৌজন্য সম্প্রতি এই প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীদের বিবরণ প্রকাশ্যে এসেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।
আপনার মতামত জানানঃ