আন্তর্জাতিকভাবে চীন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র বলে পরিচিত হলেও কাশ্মীর বিতর্কে তারা বরাবর একটা ভারসাম্যের নীতি নিয়েই চলেছে এবং এই সমস্যা দ্বিপাক্ষিকভাবে সমাধান করতে হবে, ভারতের এই বক্তব্যেও কখনও আপত্তি জানায়নি। তবে পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। চীন তাদের দীর্ঘদিনের অবস্থান পরিবর্তন করে কাশ্মীর বিতর্কে হস্তক্ষেপ করার রাস্তা বেছে নিয়েছে।
শীতকালীন অলিম্পিক্সের অনুষ্ঠানে গিয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চারদিনের সফরের শেষ দিনে চীনের সঙ্গে কাশ্মীর প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে গণমাধ্যম সূত্রে।
সংবাদ সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি)-এর দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছেন জিনপিং।
বেজিংয়ের সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, একই সঙ্গে কাশ্মীর ইস্যুর ‘শান্তিপূর্ণ’ ও ‘সুষ্ঠু’ সমাধানের কথা বলেছে চীন। ইমরানকে জিনপিং জানান, এমন কোনও একতরফা পদক্ষেপ করা হবে না, যাতে কাশ্মীর ইস্যু জটিল হয়ে ওঠে।
উল্লেখ্য, পশ্চিম চীনের শিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে কারাকোরাম পেরিয়ে প্রায় ১,৩০০ কিলোমিটার দীর্ঘ মহাসড়কের একটি অংশ গিয়েছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে। সিপিইসি প্রকল্পের এই অংশ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। তার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরুর সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে চীন।
চীনের প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের সঙ্গে একাধিক প্রকল্পে কাজ করার আশ্বাস দিয়েছেন। প্রযুক্তি, শিল্প এবং কৃষিতেও পাকিস্তানকে সাহায্য করবে বলে জানিয়েছে চীন। অন্য দিকে, পাক সংবাদ সংস্থার দাবি, জিনপিং ইমারনকে বলেছেন, সারা পৃথিবী এক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে চীন-পাক সম্পর্কের কৌশলগত গুরুত্ব প্রকট হয়ে উঠেছে।
বস্তুত এর আগেও কাশ্মীর নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল চীন এবং পাকিস্তান। ভারতের বিদেশমন্ত্রণালয় কড়া ভাষায় তার জবাব দিয়েছিল। ভারত জানিয়েছিল, কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ফলে অন্য কোনো দেশের সে বিষয়ে কথা বলার অধিকার নেই। শুধু তা-ই নয়, লাদাখ নিয়েও অন্য কোনো দেশ নাক গলাক, ভারত তা চায় না। বস্তুত, ভারতের বক্তব্য, পাকিস্তান কাশ্মীরের একটি অংশ ‘দখল’ করে রেখেছে। ভারত চায় সেখানে স্টেটাস কো বজায় থাকুক।
চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর অর্থাৎ সিপিইসি পাকিস্তানের কাশ্মীরের ভিতর দিয়ে গেছে। ভারতের তা নিয়ে তীব্র আপত্তি আছে। ওই অঞ্চলের ভিতর দিয়ে কোনো কিছুই ভারত বরদাস্ত করবে না বলে জানানো হয়েছে আগেই। এবার সেখানেই ৬০ বিলিয়ান ডলার খরচের কথা ঘোষণা করেছে চীন।
সম্প্রতি ভারতীয় পার্লামেন্টের বাজেট অধিবেশনে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বলেছিলেন, চীন এবং পাকিস্তান হাত মিলিয়ে ভারতকে ‘ঘেরার’ চেষ্টা করছে। ভারত সরকার এই বিষয়টিকে কূটনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। এর ফলে উপমহাদেশে ভারত একঘরে হয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন রাহুল। রাহুলের ওই মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল। বিজেপি রাহুলের বক্তব্যের সমালোচনা করেছিল। অ্যামেরিকাও জানিয়েছিল, রাহুল যেভাবে চীন এবং পাকিস্তানের প্রসঙ্গ এনেছেন, তা অভিপ্রেত নয়।
কিন্তু রাহুলের ওই বক্তৃতার কয়েকদিনের মধ্যেই পাকিস্তান এবং চীনের যৌথ বিবৃতি সামনে এলো। বিবৃতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক সমঝোতার কথাও বলেছে চীন। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে যেভাবে লড়াই করছে, তার প্রশংসা করেছে চীন। পাশাপাশি পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। সিপিইসি-র কাজ করতে গিয়ে বেশকিছু চীনা কর্মী পাকিস্তানে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছেন। পাকিস্তান জানিয়েছে ভবিষ্যতে যাতে এমন না হয়, সে দিকে নজর রাখা হবে।
সূত্র মতে, জম্মু ও কাশ্মীরের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনা পক্ষকে অবহিত করেছে পাকিস্তান। এই মুহূর্তে সেখানে যে অবস্থা বিরাজ করছে, যে চাপ রয়েছে তা নিয়ে উদ্বেগও তুলে ধরা হয়েছে। চীনা পক্ষ পুনর্বার বলেছে, ইতিহাসের ধারাবাহিতকায় বিরাজমান কাশ্মীর ইস্যু।
জাতিসংঘ সনদ, প্রাসঙ্গিক নিরাপত্তা পরিষদের রেজুল্যুশন এবং দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ওপর ভিত্তি করে এ সমস্যা সমাধান করা যেতে পারে শান্তিপূর্ণ ও যথাযথভাবে। একতরফা যেকোনো একশনের বিরোধী চীন। কারণ, এতে পরিস্থিতি আরও জটিল করবে।
ওদিকে ২০২১ সালের জুলাইয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি কথিত সিপিইসিতে যে রেফারেন্স তুলে ধরা হয়েছিল, তার বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন, জম্মু ও কাশ্মীর ভারতীয় ভূখণ্ডের অধীনে। তা বেআইনিভাবে দখল করে রেখেছে পাকিস্তান।
ভারতের এই মুখপাত্র বলেছেন, চীন ও পাকিস্তানকে বার বার ভারত বলে এসেছে যে, তথাকথিত সিপিইসি ভারত ভূখণ্ডে। তার ভাষায়, পাকিস্তান বেআইনিভাবে যে অঞ্চল দখল করে আছে সেখানকার স্ট্যাটাস পাল্টে দিতে অন্য দেশগুলোর যেকোনো উদ্যোগের বিরোধী ভারত। ভারতের ভূখণ্ডে পাকিস্তান যেকোনো রকম পরিবর্তন করতে গেলে তারও বিরোধী ভারত। এমন কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে ভারত।
চীন ও পাকিস্তান যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছে তাতে পাকিস্তানের আত্মত্যাগ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। উভয় পক্ষ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে। উল্লেখ্য, যুদ্ধ বিষয়ক ট্যাংক, যুদ্ধবিমান ও সর্বশেষ নৌবাহিনীর জন্য ফ্রিগেট সহ পাকিস্তানের জন্য সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে চীন। তাই ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাতে দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেছেন শি জিনপিং।
সূত্র মতে, ভারতকে নিয়ে চীনের কাছে বেশ কিছু অভিযোগ করেছেন ইমরান। কথা হয়েছে কাশ্মীর ইস্যু নিয়েও। ইমরান ও জিনপিংয়ের বৈঠকের পর একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দু’পক্ষই শান্তিপূর্ণ ও উন্নয়নশীল দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সব সময় প্রশ্ন করে এসেছে।
চীন ও পাকিস্তানের এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আঞ্চলিক সহযোগিতা বজায় থাকবে। দীর্ঘস্থায়ী শান্তি এবং সমৃদ্ধির লক্ষ্যকে সমান গুরুত্ব দেবে দুই দেশ।
পাশাপাশি চীনের সঙ্গে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেছে পাকিস্তান। পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি, অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, তথ্যমন্ত্রী ফওয়াদ চৌধুরীও প্রধানমন্ত্রী ইমরানের সঙ্গে চীনে গেছেন।
ইমরানকে জ্বালানি, তৈল পরিশোধন, পেট্রোকেমিক্যাল, পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি এবং আবাসন ক্ষেত্রে চীনা প্রকল্পের অগ্রগতি এবং ভবিষ্যতের বিনিয়োগ নিয়েও জিনপিং আশ্বাস দেন বলে দাবি সে দেশের সংবাদ সংস্থার।
এসডব্লিউ/এসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ