জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও কাঠ পাচারকারীদের কারণে বরগুনার টেংরাগিরি সংরক্ষিত বন উজাড় হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বন রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বনাঞ্চল রক্ষা করতে না পারলে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দক্ষিণাঞ্চল।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে বরগুনার তালতলী উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল টেংরাগিরি। ১৩ হাজার ৬৪৪ একরের বনটি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিলো। প্রকৃতিক দুর্যোগ, নদী ভাঙন ও বালু জমে শ্বাসমূল ঢেকে যাওয়ায় ম্যানগ্রোভ বনটির হাজারো গাছ মরে গেছে। সাথে রয়েছে বন নিধন করে গাছ পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য। এ কারণে দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ার আশঙ্কায় স্থানীয়রা। তাই তারা সরকারের কাছে বেড়িবাঁধের কাছে গাছ লাগানোর আবেদন জানায়।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, মিনি সুন্দরবনখ্যাত বরগুনার তালতলীর টেংরাগিরি বনাঞ্চল থেকে প্রতি বছর ৭০ হাজার থেকে ৮০ হাজার বড় গাছ কেটে নিয়ে যায় বনদস্যুরা। এছাড়া তীব্র নদীভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে যে কত গাছ নষ্ট হয় তার কোনো হিসাব নেই। ফলে দিন দিন গাছ কমে আয়তনে ছোট হচ্ছে সংরক্ষিত বনাঞ্চল।
জেলা বন বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৩ হাজার ৬৪৮ দশমিক ৩ একর আয়তন নিয়ে তালতলীর টেংরাগিরি বনকে ১৯৬০ সালে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। তবে গত ৬২ বছরে বনের ৩ হাজারেরও বেশি এলাকা বিলীন হয়েছে সাগরে। বনদস্যু, ঘূর্ণিঝড়, ভাঙন ও জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে তিন লক্ষাধিক গাছ।
তালতলীর টেংরাগিরি সংরক্ষিত বনে গিয়ে দেখা যায়, বনের গহিন থেকে বড় বড় কেওড়া, সুন্দরী, গেওয়াসহ নানান প্রজাতির গাছ কেটে বন উজার করে নিয়ে গেছে বনদস্যুরা। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে হওয়ায় বনের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে তীব্র ভাঙনে অনেক গাছ উপড়ে গেছে। বনটি সংরক্ষিত হওয়ায় এ বনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ হলেও বনের ভেতরে অবাধে চলাফেরা করছে স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল হাকিম মৃধা, মনোয়ার, সত্তারসহ কয়েকজন বলেন, রোজ বনের মধ্য থেকে বড় গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনদস্যুরা। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বিষয়টি জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
স্থানীয় বাসিন্দা জলিল, শাহাদাত মাঝি, হরিশঙ্করসহ কয়েকজন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, প্রতিবছরই কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হয় আমাদের। এই বন ঘূর্ণিঝড় থেকে আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসছে। বনদস্যু নির্মূল এবং ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বন বিভাগ।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের বরগুনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মুশফিক আরিফ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ভাঙন এবং বন নিধনের কারণে প্রাকৃতিক ঢাল এই টেংরাগিরি বনাঞ্চল এখন হুমকির মুখে। প্রতি বছর এখান থেকে হাজার হাজার গাছ কেটে নিয়ে যায় দস্যুরা। বন বিভাগের এই দায় এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে চরম মূল্য দিতে হবে। যা পরিবেশের জন্য খুবই ভয়াবহ হবে।
বরগুনার সংরক্ষিত বন রক্ষা কমিটির সভাপতি হাসানুর রহমান ঝন্টু বলেন, বন বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বনদস্যুদের কাছে বনের গাছ পাচার করছেন। স্থানীয়দের কাছে যার অনেকগুলো প্রমাণ রয়েছে। এমনকি সংরক্ষিত বনের গাছ বিক্রি করার সময় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন একাধিক বনরক্ষী। বন বিভাগের খামখেয়ালিপনা বন্ধ না হলে অস্তিত্ব হারাবে টেংরাগিরি।
বন বিভাগ বরগুনা সদর রেঞ্জ কর্মকর্তা মতিয়ার রহমান বলেন, ভাঙন কবলিত এলাকায় নতুন করে বনায়ন করে এবং শেল্টার বেল্ট তৈরি করে ভাঙন রোধ করা হবে। এছাড়া নতুন করে কিছু চরাঞ্চলে বনায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বনদস্যু নির্মূলে তৎপর রয়েছি আমরা।
প্রতিবছরই কোনো না কোনো ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হয় আমাদের। এই বন ঘূর্ণিঝড় থেকে আমাদের রক্ষা করে। কিন্তু প্রতিনিয়ত এই বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসছে। বনদস্যু নির্মূল এবং ভাঙনরোধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না বন বিভাগ।
বৈজ্ঞানিক সূত্রে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় বরফ গলে যাওয়ায় সাগর তলের উচ্চতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও বন বিভাগের তৈরি করা বনাঞ্চল মরে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সাগরের পানির স্তর ক্রমশই বাড়ছে। এ কারণে বেশি করে গাছ লাগালে প্রাকৃতিক এ দুর্যোগ থেকে উপকূলের মানুষ রক্ষা পেতে পারে।
স্থানীয় সচেতন মহলের ধারনা, একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও সাগরের তীব্র ভাঙন আর অন্যদিকে বনদস্যুদের অবাদে গাছ কাটার কারণেই এলাকার বনগুলোর অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বনাঞ্চল রক্ষায় বর্তমান সরকার দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে চরম মূল্য দিতে হবে, যার ফলে ভবিষ্যতে প্রানীকূল মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে।
পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে গত বছর মৌসুমি বায়ুর প্রভাব ছিল খুবই অস্বাভাবিক। এর সঙ্গে ছিল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়। সব মিলিয়ে গোটা অঞ্চলে একের পর এক বন্যা, ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে, যা প্রচুর প্রাণহানির কারণ হয়েছে। বহু দেশে প্রচুর মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। সমুদ্র ও সমুদ্র উপরস্থিত তাপমাত্রায় বড় হেরফের হয়েছে এই সময়, যা সামুদ্রিক প্রাণীর জীবনে এনেছে বড় বদল। ২০২০ সালে ভারত, প্রশান্ত ও আর্কটিক মহাসাগরের গড় তাপমাত্রা আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। এটা অবশ্য গোটা বিশ্বেই হয়েছে। তবে এশিয়ায় হয়েছে সবচেয়ে বেশি। যেমন আরব সাগরের তুলনায় এ অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বেড়েছে তিনগুণ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ঠিক কতটা, তা বোঝার অন্যতম বড় মানদণ্ড হচ্ছে সাগরের বরফের উচ্চতা। কারণ, এটি শুধু ওই নির্দিষ্ট অঞ্চল নয়, গোটা বিশ্বের জলবায়ুর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। গত বছর আর্কটিক সাগরের বরফের উচ্চতা ছিল ১৯৭৯ সালের পর সর্বনিম্ন। এর প্রভাব পড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ওপরও। ১৯৯০-এর দশক থেকে প্রতি বছর গড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৩ দশমিক ৩ মিলিমিটার করে বাড়ছে। বৈশ্বিক এই গড়ের চেয়ে এই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।
সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা মনে করেন, বনভূমি বেদখল হয়ে যাওয়ার অর্থ শুধু এই নয় যে এভাবে রাষ্ট্রের সম্পত্তি ব্যক্তি–প্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে চলে যাচ্ছে। এর অর্থ এটাও যে এইভাবে দেশের বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে এবং তার ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে বনভূমি উজাড় হতে হতে এখন ১৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে; অবশ্য এই হিসাব সরকারের বন অধিদপ্তরের। বেসরকারিভাবে ধারণা করা হয়, আমাদের দেশে এখন প্রকৃত বনভূমির পরিমাণ এর চেয়ে কম।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা জানান, অবৈধ দখলদারেরা সাধারণত স্থানীয়ভাবে ক্ষমতাবান হয়ে থাকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা এসব তৎপরতায় লিপ্ত হয় এবং তাদের ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা যথাযথভাবে কাজ করে না। তাই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের দমন করার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। বন বিভাগের অসাধু অংশের সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের যোগসাজশও ছিন্ন করতে হবে। আর অবিলম্বে বেদখলে থাকা বনভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য কঠোর ও ব্যাপক অভিযান চালানো প্রয়োজন বলে জানান তারা।
বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তারা বলেন, এজন্য নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। দেশে যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। গত শতকের আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়নের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় একটি যথোপযোগী বন আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৩১৫
আপনার মতামত জানানঃ