বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্লাস্টিক দূষণ। এরইমধ্যে সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীর পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিক বা মাইক্রো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে। এমনকি লবণেও মিলছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক। এতে ঝুঁকির মুখে মানব জীবন।
সমুদ্র দূষণের কারণে মাছের পেটে প্লাস্টিকের কণা পাওয়ার খবর নতুন নয়। তবে এবার অশোধিত লবণের মধ্যেও পাওয়া গেছে প্লাস্টিকের কণা।
খাবার লবণে অধিক মাত্রায় আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছেন একদল গবেষক। দেশের সুপার মার্কেটগুলোর নামকরা ব্র্যান্ডের লবণে পাওয়া গেছে এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের উপস্থিতি।
দেশে প্রথমবারের মতো লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক নিয়ে এ গবেষণায় জনস্বাস্থ্যের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ দিকও উঠে এসেছে।
গত ১৫ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা জার্নাল ‘ইনভাইরনমেন্টাল অ্যাডভান্সেস’ এ গবেষণা নিবন্ধটি ‘প্রলিফেরেশন অব মাইক্রো-প্লাস্টিক ইন কমারশিয়াল সি সল্ট ফ্রম দ্য ওয়াল্ড লংগেস্ট সি-বিচ অব বাংলাদেশ’ নামে প্রকাশিত হয়।
গবেষণাটি পরিচালনা করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফি মুহাম্মদ তারেক, সহযোগী অধ্যাপক ড. ফাহমিদা পারভিন এবং একই বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী জয়শ্রী নাথ ও তামান্না হোসেন।
গবেষণায় উঠে আসে, বঙ্গোপসাগর থেকে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা খাবার লবণে বড় ধরনের পলিমার প্লাস্টিক যেমন পলিস্টেরিন, ইথিলিন-ভিনাইল এসিটেট, পলিথিলিন, নাইলন, পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট প্রভৃতি পাওয়া গেছে। এই আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। লবণে এ প্লাস্টিক অনেকটা তন্তুময় এবং খণ্ডবিখণ্ড অবস্থায় থাকে।
দেশে প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণে ৩৯০ থেকে ৭৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এসব প্লাস্টিকের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ফাইবার আকৃতির, ৩৫ শতাংশ খণ্ডবিখণ্ড এবং ৩৮ শতাংশ স্বচ্ছ এবং ৩৫ শতাংশ নীল রংয়ের।
গবেষণায় উঠে আসে, বঙ্গোপসাগরের লবণে অতি মাত্রায় আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক থাকায় অগভীর ও তীরবর্তী এলাকায় থাকা বাদামি চিংড়ির মধ্যে প্রতি গ্রামে ৩ দশমিক ৪ ও বাগদা চিংড়িতে ৩ দশমিক ৮৭ গ্রাম আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। যা অতি খারাপ অবস্থার ইঙ্গিত করে।
গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে পাঁচ গ্রাম লবণ খাওয়া উচিত। অথচ দেশে এর মাত্রা গড়ে ১৩.৪ গ্রাম। এছাড়াও ভোক্তারা প্রতি বছর গড়ে লবণে থাকা ১৩০৮৮ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক কণা ভক্ষণ করে আসছেন।
গবেষণায় বঙ্গোপসাগর থেকে পাওয়া লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের হার বেশির কারণ হিসেবে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিক দ্রব্যকে দায়ী করা হয়। এছাড়াও নিত্য ব্যবহার্য পণ্যে মাইক্রো এবং ন্যানো পর্যায়ের কিছু প্লাস্টিক থাকে যা অধিক পরিমানে দায়ী। পাশাপাশি বড় মাপের প্লাস্টিক পণ্য জৈবিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভেঙে একসময় এসব মাইক্রো প্লাস্টিক তৈরি করে।
মানব শরীরে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া নিয়ে গবেষণায় বলা হয়, আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক অন্ত্রে ক্ষতের সৃষ্টি করে। ফলে ভোক্তার মলে প্লাস্টিকের উপস্থিতি এবং প্রদাহজনক পেটের রোগ সৃষ্টি হয়। এ অবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে ডিএনএ ক্ষতি হয়। যার কারণে হতে পারে ক্যান্সার।
দেশে প্রতি কেজি সামুদ্রিক লবণে ৩৯০ থেকে ৭৪০০ আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এসব প্লাস্টিকের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ফাইবার আকৃতির, ৩৫ শতাংশ খণ্ডবিখণ্ড এবং ৩৮ শতাংশ স্বচ্ছ এবং ৩৫ শতাংশ নীল রংয়ের।
এছাড়াও ভক্ষণের পর আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক দীর্ঘদিন ধরে পেটে থেকে যায়। এতে অন্যান্য ক্ষতিকর অণুজীব তার উপর বাসা বাধার সুযোগ পায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসব প্লাস্টিক কণা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়, যা হরমোন সমস্যা সৃষ্টি এবং স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে দেশের জনপ্রিয় ১০ ব্র্যান্ডের লবণসহ ১৩ স্যাম্পল বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও স্থানীয় দোকান থেকে সংগ্রহ করে গবেষণায় ব্যবহার করা হয়। ব্র্যান্ডের ও ‘খোলা’ উভয় লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। তবে খোলা লবণে আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিকের মাত্রা ব্র্যান্ডের লবণের তুলনায় অনেক বেশি।
এ বিষয়ে পাবলিক হেল্থ অ্যন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. তাজউদ্দিন সিকদার এক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, মাইক্রো প্লাস্টিক সাধারণত হজম হয় না। এর আকার ক্ষুদ্র হওয়ায় খুব সহজে এটি কোষের মধ্যে ঢুকে যায়। এর প্রভাবে স্নায়ুবিক সমস্যার পাশাপাশি পরিপাকতন্ত্রের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বেশি।’
প্রধান গবেষক অধ্যাপক ড. শফি মুহাম্মদ তারেক বলেন, ‘মাইক্রো প্লাস্টিকের আধিক্য দূর করতে প্রথমত প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনায় অধিক নজর দেওয়া দরকার। বঙ্গোপসাগরের পানিতে যেহেতু ইতোমধ্যেই অনেক বেশি পরিমাণে প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে তাই লবণ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিশোধনের জন্য আরও উন্নত যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সরকারকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।’
প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে আমাদের বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী এলাকায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, এমন তথ্যই জানিয়েছেন আমাদের মৎস্য ও কৃষি বিজ্ঞানিরা।
এক গবেষণা রিপোর্টে বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে বছরে ২০ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে এসে পড়ছে। চীন, ভারত, মিয়ানমার, নেপাল ভূটান থেকেও এসব প্লাস্টিক বর্জ্য এসে পড়ছে আমাদের বঙ্গোপসাগরে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ও অণুজীবের পেটে ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এমনকি পরিশোধিত-অপরিশোধিত উভয় প্রকার লবণেই ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের অস্তিত্ব ধরা পড়েছে বলে জানান তারা।
প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতির কারণে মানব শরীরে ক্যান্সারসহ দুরারোগ্য নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে বলে জানান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। বঙ্গোপসাগরে এই প্লাস্টিক দূষণের ঘটনাকে ভবিষ্যত জনস্বাস্থের জন্য একটি ভয়াবহ ও মারাত্মক হুমকী হিসাবে দেখছেন বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা জানান, মাইক্রো প্লাস্টিক বা প্লাস্টিক কণা আকারে খুবই ছোট বলে মাছ ও অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণি এগুলোকে নিজেদের খাবার ভেবে ভুল করে খেয়ে ফেলে। আর প্লাস্টিক খাওয়া সেই মাছ আমরা ভক্ষণ করি। মানে পরোক্ষভাবে আমরাও প্লাস্টিক ভক্ষণ করি।
তারা বলেন, আমরা যেখানেই প্লাস্টিকের দূষণ করি না কেন, তা সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। আর এসব প্লাস্টিকের মধ্যে বড় আকারের যেমন আছে, তেমনি আছে ৫ মাইক্রোমিটার বা তারও চেয়ে ক্ষুদ্র। আবার বড় প্লাস্টিকও সমুদ্রে গিয়ে ক্ষুদ্র আকারে ভেঙ্গে যায়।
সাগরে কিছু প্লাস্টিক ভাসমান আর কিছু প্লাস্টিক তলদেশে থাকে। এ উভয় প্রকার প্লাস্টিকই আমাদের সমুদ্রের প্রাণিকূলের জন্য ক্ষতিকর।
আরও বলেন, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের পর তা পানির তোড়ে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙে। ভাঙা অংশগুলো পুনরায় সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে ভেঙে ন্যানো, মাইক্রো ও ম্যাক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।
তারা বলেন, এই ভাঙনের ফলে সৃষ্ট প্লাস্টিকের কিছু উপাদান (ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, যেমন—বিসফিনল-এ নির্গত হয়) মানুষের দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর । প্লাস্টিক-দূষিত মাছ খাওয়ার ফলে আমরা বিসফিনল-এ দূষণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। মাছ ছাড়াও সমুদ্রের অমেরুদন্ডী প্রাণিও মাইক্রোপ্লাটিক ‘ফিল্টার করে’ গ্রহণ করে বলে জানান তারা।
এছাড়া সমুদ্রের ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বা জু-প্লাঙ্কটন এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ভক্ষণ করে। আবার এসব ক্ষুদ্র প্রাণিকণা বিভিন্ন মাছের খাদ্য বলে মাছ এদেরকে ভক্ষণ করে। আর আমরা সেই মাছ খেতে গিয়ে আমরাও মাইক্রোপ্লাস্টিক খাই।
বিজ্ঞানীরা জানান, মাছের পেটে ছোট-বড় প্লাস্টিক পাওয়া থেকে বুঝা যায়, কিছু কিছু মাছ সরাসরি প্লাস্টিক ভক্ষণ করে থাকে।
প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু আমাদের বঙ্গোপসাগরের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর নদ-নদী ও সমুদ্রগুলোর দূষণের জন্য প্রধান দায়ী। পৃথিবীর নদীগুলো থেকে সমুদ্রে প্রতিবছর ১২ থেকে ২৪ কোটি মেট্রিক টন প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/২০১০
আপনার মতামত জানানঃ