ইমরান খানের আমলে মুদ্রাস্ফীতির নতুন রেকর্ড স্পর্শ করেছে পাকিস্তান। বিগত ৭০ বছরে মুদ্রাস্ফীতির এমন করুণ ছবি দেখেনি পাকিস্তানের মানুষ। রাজনৈতিক ভাবে বিরোধী দলগুলির চাপ তো ছিলই, এখন আবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে সাধারণ নাগরিকদের প্রতিবাদ। মুদ্রাস্ফীতির জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পাকিস্তানের আমজনতা প্রতিবাদে নেমেছেন ইমরানের সরকারের বিরুদ্ধে।
এদিকে, চলতি সপ্তাহে দেশের নানা সমস্যা নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এ সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ে তিনি বলেন, এটা নতুন কিছু নয়। বিশ্বের ‘অন্যতম সস্তা দেশে’ এটি থাকবে।
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?
শেষ তিন বছর ধরে পাকিস্তানে যে হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে, তা বিগত ৭০ বছরে দেখা যায়নি। সব খাবারের দাম দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ঘি, তেল, চিনি, ময়দা এবং পোলট্রিজাত খাবারের দাম অতীতের সবে রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে।
করাচিতে একটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে কর্মরত রশিদ আলম বলেন, ‘কোনো কিছু ঠিক নেই। বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। আর এটাই পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা।’
২০২২ সালে পাকিস্তানে ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রায় তিন বছর ধরে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি থমকে আছে।
অপরদিকে গত জুলাই মাস থেকে ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানের রুপি বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। এই সময়ে প্রবাসী পাকিস্তানের রেমিট্যান্স বেড়েছে প্রায় ১০ শতাংশ (১২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার)।
বিশ্বব্যাংকের মতে, গত বছর পাকিস্তানে প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। ইমরান খান পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত ভোজ্যতেলের দাম ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। অপর দিকে গত এক বছরে প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ বা ১৪৫ পাকিস্তানি রুপি।
ফেডারাল বিউরো অব স্ট্যাটিস্টিকসের রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত সময়ের ব্যবধানে, বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ভারতীয় মুদ্রায় ৪ টাকা ৬ পয়সা থেকে বেড়ে অন্তত ৬ টাকা ৩৮ পয়সায় এসে দাঁড়িয়েছে।
ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, গত অক্টোবরের প্রথম ত্রৈমাসিকে, এলপিজির ১১.৬৭ কেজি সিলিন্ডারের দাম ৫১ শতাংশ বেড়েছে। আগে যেখানে দাম ছিল ১ হাজার ৫৩৬ টাকা, এখন তা বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ৩২২ টাকা। একইভাবে, তিন বছরে পেট্রলের দাম বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। পেট্রলের দাম লিটার প্রতি ৯৩ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বেড়ে ১৩৮ টাকা ৭৩ পয়সায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
সবথেকে বেশি বেড়েছে ঘি, তেল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের দাম। ঘি-এর দাম ১০৮ শতাংশ বেড়ে প্রতি কেজি ৩৫৬ টাকা হয়েছে। তিন বছরে চিনির দাম ৮৩ শতাংশ বেড়েছে। প্রতি কেজি চিনি আগে যেখানে ৫৪ টাকায় কিনতে পাওয়া যেত এখন তার কেজি পিছু দাম ১০০ টাকারও বেশি।
আন্তর্জাতিক এক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানে এখন ডালের দাম ৬০-৭৬ শতাংশ বেড়েছে। মাশ ডালের দাম বেড়েছে ২৪৩ টাকা, চিনাবাদামের দাম বেড়েছে ১৬২ টাকা, মুসুর ডালের দাম প্রতি কেজি ১৮০ টাকা বেড়েছে এবং ছোলার ডালের দাম ২৩ শতাংশ বেড়ে ১৪৫ টাকা প্রতি কেজিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
দেশটির জনগণের করুণ পরিণতি
পাকিস্তানের বাণিজ্যিক রাজধানী করাচি। এখানকার একটি ব্যস্ততম এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করেন গৃহিণী মাইরা তায়েব (৪০)। মোটামুটি সচ্ছল জীবন যাপন করে আসছিলেন।
কিন্তু সম্প্রতি পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতির হার এতটাই বেড়েছে যে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। বাধ্য হয়ে ধারদেনা করেই সংসারে অর্থের জোগান দিতে হচ্ছে।
একই অবস্থা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ হানিফেরও। তার আর্থিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটায় অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কথাও ভাবছেন তিনি। আবেগাপ্লুত হয়ে এসব কথা বললেও তারা খুবই সৎ, যা নিয়ে নিজেরা গর্বিত।
কিন্তু তাদের এই কষ্ট লাখো পাকিস্তানি নাগরিকের প্রতিচ্ছবি। আর এই অসন্তোষ আগামী বছরের পুনর্নির্বাচনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জয়ী হওয়াকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
তায়েব বলেন, মধ্যবিত্ত হওয়ায় আমরা ভিক্ষাও করতে পারি না। তিনি আরও বলেন, শেষ পর্যন্ত এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করব, সেটি আমাদের জানা নেই।
তায়েবের কথারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা গেল পাঁচ সন্তানের জননী খুরশেদ শরিফের কণ্ঠে। যিনি তার পরিবারের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে অভিশাপ দিলেন। ভাড়া করা জীর্ণ বাড়ির সামনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, এই সরকারের অধীনে একমাত্র মৃত্যুই বেঁচে থাকার বিকল্প হতে পারে।
ইমরান খান কতটা দায়ী?
২০১৮ সালে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) যখন ক্ষমতায় আসে, তখন তিনি কয়েক দশক ধরে চলা দুর্নীতি এবং কুসংস্কার দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ইতিমধ্যে সাম্প্রতিক নির্বাচনে এর প্রভাব পড়েছে।
গত মাসে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের প্রাদেশিক নির্বাচনে হেরেছে পিটিআই।
মানবাধিকারকর্মী ও রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকার তওসিফ আহমেদ খান বলেন, সরকার অর্থনৈতিক কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই গর্বের ভিত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে গেছে।
নির্বাচনী প্রচারণায় পাকিস্তানকে একটি কল্যাণকর ইসলামি রাষ্ট্রের কথা বলেছিলেন ইমরান খান। দরিদ্রদের জন্য সামাজিক প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য কার্যকর বাণিজ্যিক কর এবং ব্যক্তিপর্যায়ে অনুদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইমরান খান এ বিষয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করেছে। তার এসব পরিকল্পনা রাষ্ট্র পরিচালনায় খুব কম পরিবর্তন এনেছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১০৫৫
আপনার মতামত জানানঃ