বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুরুষের তুলনায় বেশি ঝুঁকিতে আছেন নারীরা। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি।
‘বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ হাউসহোল্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে’ নামের প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় গত অক্টোবরে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের আর্থিক প্রভাব নিয়ে এ ধরনের জরিপ এই প্রথম। ১০টি জেলার ৩ হাজার ৯৫টি খানা বা পরিবারের ওপর এ জরিপ চলে। এর মধ্যে ৪২ শতাংশের বেশি পরিবার বন্যাদুর্গত এবং ৪০ শতাংশের বেশি ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাকিরা কোনো না কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভুক্তভোগী।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ এবং ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিসিএডি) পরিচালক সালিমুল হক বলেন, ‘পুরুষদের তুলনায় নারীরা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মানবসৃষ্ট এ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির ভার সবচেয়ে বেশি তাদের সামলাতে হয়। পরিস্থিতি সামলাতে তাদের কাছে থাকা শেষ সম্পদটুকুও তারা ব্যবহার করতে বাধ্য হন।’
নারীদের মধ্যে গর্ভবতী নারীদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্ভাবনা আছে বলে সম্প্রতি এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেলের আলোচনায় নতুম এই তথ্য উঠে এসেছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গর্ভবতী নারীদের ক্ষতির চেয়ে মানুষ পোষা প্রাণীদের ক্ষতি নিয়ে বেশি সচেতন বলেও এক সমীক্ষায় জানা গেছে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কার্বন নিঃসরণ, মোটরগাড়ির ধোঁয়া, জীবাশ্ব জ্বালানি, কাঠ পোড়ানো ও দাবানলের ধোঁয়ার কারণে গর্ভবতী নারী ও গর্ভস্থ ভ্রূণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের রোগ ও মানসিক চাপের মতো স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে তারা।
সাম্প্রতিক গবেষণায় বায়ু দূষণ ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে জলবায়ু বিপর্যয়ের তীব্রতা অনেকটাই বেড়েছে বলে জানা গেছে। আর এই তীব্রতাই প্রসূতি, ভ্রূণ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি ২০ লাখ প্রসবের ঘটনা পর্যালোচনা করে আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন দেখেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বায়ুদূষণ ও উষ্ণায়ন প্রসূতি, ভ্রূণ ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব গর্ভধারণ পর্যায় থেকে শুরু করে মৃত শিশু জন্ম দেওয়া, জন্মহার কমে যাওয়া, কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়া, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে শিশুর জন্মসহ নানা সমস্যার সঙ্গে জড়িত।
পুরুষদের তুলনায় নারীরা বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। মানবসৃষ্ট এ জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির ভার সবচেয়ে বেশি তাদের সামলাতে হয়। পরিস্থিতি সামলাতে তাদের কাছে থাকা শেষ সম্পদটুকুও তারা ব্যবহার করতে বাধ্য হন।’
নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, বায়ু দূষণের সঙ্গে জড়িত সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কণা মায়ের ফুসফুসে পৌঁছে যায়। এর ফলে তাদের ফুসফুসের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এসব কণা প্লাসেন্টায় পৌঁছে প্রদাহও তৈরি করে। এটি মূলত গর্ভাবস্থার ডায়াবেটিস ও প্রি-অ্যাকলেমসিয়ার জন্য দায়ী।
পাশাপাশি অতিরিক্ত গরম আবহাওয়া গর্ভবতী নারীর মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। যে কারণে ঝিঁমুনি থেকে শুরু করে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টও হতে পারে। জানা যায়, অ্যাজমা আছে এমন নারীদের পাশাপাশি সংখ্যালঘু বিশেষ করে কালো নারীদের গর্ভাবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব বেশি।
জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী বেশি পুরুষরা
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট মহামারিতে সারা বিশ্ব যেভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে, তাতে প্রকৃতি নিজের শুশ্রূষা কিছুটা হলেও করতে পেরেছে। বাধ্য হয়ে আরোপিত লকডাউনের কারণে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ আগের চেয়ে অনেক কমেছে, কমেছে বায়ুদূষণও। কিন্তু এত সবেও বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কিন্তু থামানো যাচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে লকডাউনের কারণে প্রাকৃতিক পরিবেশের লাভ হলেও, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ওপর এর প্রভাব নগণ্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বৈশ্বিক উষ্ণতা এখন তুঙ্গে। এখন পর্যন্ত রেকর্ড বইয়ের তথ্যে এ বছরের জুলাই মাসটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে ক্রমাগত বিপদ বাড়ছে মানব সভ্যতার।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য পুরুষরাই বেশি দায়ী। নারীর তুলনায় পুরুষ মাংসজাতীয় আমিষ খাবার ৪০ শতাংশ বেশি গ্রহণ করে। গবেষণা অনুসারে, নারীর চেয়ে পুরুষের এই বেশি আমিষযুক্ত খাবার জলবায়ু সংক্রান্ত উষ্ণতা বৃদ্ধিতে বেশি দায়ী।
জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান দু’টি পদার্থ কয়লা আর ডিজেল। এ দু’টি পদার্থের ব্যবহার এখন পৃথিবীতে সব থেকে বেশি। ফলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নিঃসরণ বেড়ে গেছে মারাত্মকভাবে। কার্বনের এই নিঃসরণ যদি কমিয়ে আনা না-যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে বছরে এক বার করে ৩০ কোটি মানুষ বসবাসের বিশাল এলাকা সমুদ্রের পানিতে তলিয়ে যাবে বলে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে।
মাথাপিছু কার্বন নিঃসরণের দিক থেকে দায়ীদের মধ্যে শীর্ষে মধ্যপ্রাচ্য আর শিল্পোন্নত দেশগুলো৷ তবে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো সম্মিলিতভাবে যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ করে, তার চেয়ে একাই বেশি নিঃসরণ করছে চীন। জলবায়ু উষ্ণকারী গ্যাস নিঃসরণে দেশ ভিত্তিক প্রভাব ও পার্থক্য নিয়ে গবেষণা হলেও এবার লিঙ্গ ভিত্তিক প্রভাব ও পার্থক্য নিয়ে গবেষণা হয়েছে।
দুই লিঙ্গের মধ্যে পর্যালোচনামূলক এ গবেষনা করা হয় সুইডেনে। এতে দেখা যায়, নানান ধরনের পণ্য ক্রয়ে পুরুষরা যে অর্থ ব্যয় করেন তার কারণে নারীদের চাইতে ১৬ শতাংশ বেশি জলবায়ু উষ্ণতা সৃষ্টিকারী গ্যাস নিঃসরণ হয়। খরচের পরিমাণ প্রায় একই হওয়ার পরও পণ্য নির্বাচনের ভিন্নতাই এক্ষেত্রে মূল কারণ। সবচেয়ে বড় পার্থক্য গড়ে দিয়েছে কারের ডিজেল ও পেট্রোলের জন্য পুরুষদের করা খরচ।
এতে আরও দেখা যায়, খাদ্য ও ছুটি কাটাতে করা খরচে নারী ও পুরুষ উভয় লিঙ্গের ক্ষেত্রেই তাদের সৃষ্ট মোট নিঃসরণের অর্ধেকের বেশি ঘটছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, মাংসের পরিবর্তে উদ্ভিদজাত খাদ্য গ্রহণ করলে এবং ছুটি কাটাতে বিমান বা ব্যক্তিগত গাড়িতে ভ্রমণের চাইতে ট্রেনের মতো গণপরিবহন ব্যবহার করলে মানবসৃষ্ট নিঃসরণ ৪০ শতাংশ কমে আসবে।
গবেষণা সংস্থা- সুইডিশ রিসার্চ কোম্পানি ইকোলুপের বিশেষজ্ঞ আনিকা কার্লসন কানায়েমা বলেন, ‘নারী ও পুরুষের মধ্যকার পার্থক্য আমলে নিয়ে সঠিক পরিবেশ নীতি গ্রহণ করা সম্ভব বলে আমরা মনে করছি’।
‘উভয় পক্ষের ব্যয় প্রবণতা ছিল প্রচলিত ধ্যান-ধারণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। যেমন; নারীরা গৃহসজ্জা, স্বাস্থ্য এবং পোশাকে বেশি অর্থ ব্যয় করেন। আর পুরুষরা করছেন গাড়ির জ্বালানি, ঘরের বাইরে খাদ্য গ্রহণ, অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় এবং তামাকের পেছনে’।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় শিল্পোন্নত দেশগুলো মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করছে কয়লা, ডিজেল। এতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের উদ্গীরণ বেড়ে গেছে ভয়াবহরকমভাবে। এই কার্বন-ডাই-অক্সাইডই পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বাড়িয়ে দিয়েছে, পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত ওজোন স্তরকে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পৃথিবীর তাপমাত্রা অব্যাহতভাবে বেড়ে চলেছে। কার্বন নিঃসরণের মাত্রা ঠিক করবার কাজটি নিয়ে যত সময়ক্ষেপণ হবে, মতানৈক্য থাকবে, তত বেশি মোকাবিলা করতে হবে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি। সেই ঝুঁকি এড়াবার পথ হলো, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহকে এক টেবিলে বসিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে অবশ্যই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
আমাদের একটি নতুন, উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা দরকার। বনভূমি উজাড় বন্ধ করা আজ সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। উডল্যান্ড ট্রাস্ট আগামী ১০ বছরে ৬৪ মিলিয়ন গাছ লাগানোর কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। তাকে অনুসরণ করাই হতে পারে আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার একটি বিকল্প পথ।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬০৫
আপনার মতামত জানানঃ