করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে গত বছর সরকার চলাফেরায় নানা বিধি-নিষেধ আরোপের পাশাপাশি দেশজুড়ে লকডাউন দেয়। এই লকডাউনের ফলে পরিবহন, হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং দোকান এ তিনটি খাতের শ্রমিকদের আয় গড়ে কমেছে ৮১ শতাংশ। ওই সময় ৮৭ শতাংশ শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছে। তাদের ৭ শতাংশ এখনো বেকার।
গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়। রাজধানীর ধানমণ্ডিতে বিলসের উপপরিচালক (গবেষণা) মো. মনিরুল ইসলাম গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বিলস জানায়, দেশে গত বছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় ধাপের বিধিনিষেধের কারণে ঢাকা শহরে আলোচ্য তিন খাতের শ্রমিকেরা কী ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তা জানার জন্য এই গবেষণা করা হয়েছে। এতে বিধিনিষেধের সময় শ্রমিকদের কর্মসংস্থান, আয়ের ওপর প্রভাব, সামাজিক সুরক্ষা ও ক্ষতি পুনরুদ্ধারের তথ্য খোঁজা হয়েছে। এ জন্য শ্রমিকদের বিধিনিষেধের আগের অবস্থার সঙ্গে বিধিনিষেধ চলাকালীন ও পরবর্তী সময়ের তুলনা করে পরিস্থিতি যাচাইয়ের চেষ্টা করা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়, বিধিনিষেধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন পরিবহন খাতের শ্রমিকেরা। এই খাতের প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতির মুখের পড়েন। আর দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে কাজ হারানোর হার ছিল প্রায় ৮৩ শতাংশ। তিন খাত মিলিয়ে কাজ হারান ৮৭ শতাংশ শ্রমিক। তবে বিধিনিষেধের সময়ে এসব খাতে পূর্ণকালীন কাজ কমলেও খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ বৃদ্ধি পায়। যেমন বিধিনিষেধের সময় যেখানে পূর্ণকালীন কাজ কমেছে ৯৭ শতাংশ, সেখানে খণ্ডকালীন কাজ বেড়ে দাঁড়ায় ২১৫ শতাংশ।
বিলসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিধিনিষেধকালে শ্রমিকেরা সপ্তাহে ছয় কর্মদিবসের মধ্যে মাত্র এক দিন কাজ করতে পেরেছেন। সে হিসাবে মোট কর্মদিবস কমেছে ৮৫ শতাংশ। আর মোট কর্মঘণ্টা কমেছে ৯২ শতাংশ। দুই ক্ষেত্রেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবহন খাত। বিধিনিষেধের মধ্যে ৯৫ শতাংশ বাস ও লেগুনা চালাতে এবং ৮০ শতাংশ দোকানপাট খুলতে পারেননি মালিকেরা।
গবেষণায় দেখা গেছে, লকডাউনে তিনটি খাতের শ্রমিকদের আয় গড়ে ৮১ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৯৬ শতাংশ) ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে পরিবহন খাতের শ্রমিকরা। এ ছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতের শ্রমিকদের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। লকডাউনের আগে যেখানে মাসে গড় আয় ছিল ১৩ হাজার ৫৭৮ টাকা, লকডাউনে তা নেমে এসেছিল দুই হাজার ৫২৪ টাকায়। লকডাউন-পরবর্তী সময়ে আয় দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৫২৯ টাকা। অর্থাৎ লকডাউন-পরবর্তী সময়েও ৮ শতাংশ আয়ের ঘাটতি রয়েছে।
বিধিনিষেধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন পরিবহন খাতের শ্রমিকেরা। এই খাতের প্রায় ৯৫ শতাংশ শ্রমিক ক্ষতির মুখের পড়েন। আর দোকানপাট ও হোটেল-রেস্তোরাঁ খাতে কাজ হারানোর হার ছিল প্রায় ৮৩ শতাংশ। তিন খাত মিলিয়ে কাজ হারান ৮৭ শতাংশ শ্রমিক।
লকডাউনে শ্রমিকদের পরিবারে আয় ও ব্যয়ের ঘাটতি ছিল প্রায় ৭৭ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ পরিবহন খাতের শ্রমিকদের এবং সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ খুচরা দোকান বিক্রেতা খাতের শ্রমিক পরিবারের। ২০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার সম্পত্তি বিক্রি, খাবার কমিয়ে দেওয়া এবং সন্তানদের কাজে পাঠানোর মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করেছে। এ ছাড়া ৮০ শতাংশ শ্রমিক পরিবার ধার করে এবং সঞ্চয় কমিয়ে নিজেদের ব্যয় নির্বাহ করেছে। লকাডাউন-পরবর্তী সময়ে সঞ্চয় কমেছে ৬৪ শতাংশ এবং সঞ্চয়কারীর সংখ্যা কমেছে ৫০ শতাংশ।
গবেষণা অনুযায়ী, ৩৬ শতাংশ শ্রমিক করোনা প্রতিরোধক টিকা নিয়েছে এবং ৬৪ শতাংশ শ্রমিক এখনো টিকার আওতার বাইরে। করোনা মহামারির বাস্তবতায় বেসরকারি খাতে নিয়োজিত পরিবহন শ্রমিক, হোটেল-রেস্তোরাঁ শ্রমিক এবং দোকান শ্রমিকদের সুরক্ষায় ১০ দফা সুপারিশ তুলে ধরেছে বিলস।
এগুলো হলো—বেসরকারি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেইস প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া, একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনার আওতায় বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের ক্রমান্বয়ে পেশা উল্লেখসহ পরিচয়পত্র প্রদান, দুর্যোগকালীন বেসরকারি খাতে কর্মরত শ্রমিকদের সহায়তার জন্য একটি সঠিক ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ, বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনা টিকা প্রদান নিশ্চিত করা, বেসরকারি খাতের শ্রমিকদের সামাজিকভাবে সুরক্ষার জন্য বাধ্যতামূলকভাবে বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা ইত্যাদি।
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দেশে কর্মসংস্থানবিহীন প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এ রকম প্রবৃদ্ধি আরো বৈষম্য সৃষ্টি করবে। বৈষম্য থাকলে সমাজ টেকসই হয় না। জনগোষ্ঠীর বিরাট একটি অংশ চাকরির বাজারের বাইরে থাকলে তাদের অবদান থেকে সমাজ বঞ্চিত হয়। শুধু তারাই নয়, অর্থনীতিও বঞ্চিত হয়। কোনো না কোনো সময় গিয়ে সেই প্রবৃদ্ধি আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না।’
ডিজিটাল বৈষম্যও বাড়ছে উল্লেখ করে তারা বলেন, যারা উচ্চ আয়ের মানুষ তারাই বেশি ডিজিটাল সুবিধা পাচ্ছে। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বার্থে সামগ্রিক ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে।
তারা বলেন, ‘ডিজিটাল প্রযুক্তির যত প্রসার ঘটছে, বৈষম্যও তত বাড়ছে। যেকোনো প্রযুক্তির বিকাশের প্রথম পর্যায়ে এই বৈষম্য থাকবে। কিন্তু ডিজিটাল বৈষম্য কমানোর কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৬
আপনার মতামত জানানঃ