মৃতকে জীবিত করার চেষ্টা বিজ্ঞানীরা করে আসছেন বহুকাল আগে থেকে। সফলতাও পেয়েছেন। এমনকি কাজগুলো মোটেও বিতর্কিত নয়। সর্বশেষ ১০ বছরে পাঁচবার বিজ্ঞানীরা হাজার বছর ধরে মৃতের মতো পড়ে থাকা প্রাণকে জীবিত করেছেন।
যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা মানব জীবনের সব সীমাবদ্ধতা নিয়েই ভেবেছেন। অনেক সমস্যার সমাধান তারা করেছেন। তেমনি অনেক বিষয় এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। তাদের এই প্রচেষ্টাকে যেমন যুগে যুগে মানুষ সমর্থন করেছে।
ঠিক তেমনি তাদের কর্মকাণ্ড বুঝতে পারেনি বিধায় বিজ্ঞানের বিষয়ে এক ধরনের ভীতিও সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করেছে। যার মূল্য দিতে হয়েছিল গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের নাম না জানা আরও অনেক বিজ্ঞানীর।
বিলুপ্ত পর্বতের ছাগল বুকার্ডোকে ফিরিয়ে আনা
২০০০ সালে পৃথিবীর শেষ বুকার্ডো গাছের নিচে চাপা পড়ে মারা যায়। বুকার্ডোটির নাম ছিল সেলিয়া। এরা পাইরেনিয়ান আইবেক্স বা পর্বত ছাগল নামেও পরিচিত।
বিজ্ঞানীরা সেলিয়ার কোষগুলোকে সংরক্ষণ করেছিলেন। পুনরায় একে ফিরিয়ে আনার জন্য। পরবর্তীতে তার কোষ থেকে নিউক্লিয়াস সংগ্রহ করে স্যারোগেট প্রজাতির ছাগলের মাতৃগর্ভের ভ্রূণে স্থাপন করা হয়।
গবেষকরা প্রথম ক্লোন করা ভেড়া ডলিকে যেভাবে ক্লোন করা হয়েছিল। সেই কৌশলেই বিজ্ঞানীরা বুকার্ডো প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন।
বিজ্ঞানীরা সফলভাবে এই কাজটি করতে সক্ষম হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেলিয়ার ক্লোনটি মাত্র ১০ মিনিট বেঁচেছিল। পৃথিবীর একমাত্র প্রজাতি হিসেবে দুবার বিলুপ্ত হয় বুকার্ডো।
বিজ্ঞানীরা ২০১৩ সালে, সেলিয়ার কোষগুলো পরীক্ষা করার জন্য তহবিল পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সেলিয়াকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেননি তারা।
হাজার বছরের পুরাতন আর্কটিক রোটিফারকে ফিরিয়ে আনা
সাইবেরিয়ান হিমবাহের নিচে ২৪ হাজার বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা বিডেলইডিয়াকে বের করে নিয়ে আসেন বিজ্ঞানীরা। বিডেলেইডা মূলত আণুবিক্ষণিক প্রাণী। এ ধরনের প্রজাতিকে রোটিফারের গণতে ফেলা হয়। আর্কটিক প্রাণ হওয়ায় বিজ্ঞানীর নাম দেয়া হয় আর্কটিক রোটিফায়ার।
বিডেলেইডা রোটিফায়ার একটি বহুকোষী প্রাণী। তবে এতই ছোট যে একে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখতে হয়। তাদের আকারের বিচারে উত্তাপের মধ্যে, শীতের মধ্যে, খাদ্যের অভাবের মধ্যে এমনকি কম অক্সিজেনের মধ্যেও বেঁচে থাকার সুখ্যাতি আছে এর।
ইউএস ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে গবেষকদের একটি দল দেখতে পায়, তারা যে শুধু বরফের মধ্যেই বেঁচে থাকতে পারে, এমনটি নয়। বিডেলেইডা রোটিফার ২৪ হাজার বছর ধরে সাইবেরিয়ান হিমবাহের নিচে চাপা পড়ে থাকার পরেও বেঁচে রয়েছে।
এ ধরনের রোটিফায়ারের বেঁচে থাকার পদ্ধতিকে ‘সাসপেনডেড এনিমেশন’ বলে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ বন্ধ করে দীর্ঘ মেয়াদে প্রাণীদের বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটিকে সাসপেনডেট অ্যানিমেশন বলে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, এই হিমায়িত অবস্থায় রোটিফারগুলো শুধু ছয় থেকে ১০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। এখন গবেষকরা রেডিওকার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে জানতে পারেন যে এই রোটিফারের বয়স জানতে পারে। পার্থজেনেসিস প্রক্রিয়ায় একে ক্লোন করে বংশবিস্তার করতেও সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বরফ থেকে একটি জীবন্ত প্রাণীকে পুনরুত্থিত করার এবং ক্লোন করার সম্ভাবনা একটি বিজ্ঞান কল্পকাহিনি চলচ্চিত্রের মতো মনে হতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা একেই বাস্তব করেছেন।
প্লাইস্টোসিন যুগের উদ্ভিদকে পুনর্জীবিত করা
রাশিয়ার অঞ্চলে ৬৫ শতাংশ এলাকা সারা বছর হিমায়িত থাকে। কেউ যদি হাজার বছর ধরে জমে থাকা প্রাণীর সন্ধান করে, তার জন্য রাশিয়া হলো সেরা জায়গা।
২০১২ সালে রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের একটি দল গবেষণাপত্র প্রকাশ করে। সেই গবেষণা পত্রে তারা দেখায়, কিভাবে ৩২ হাজার বছর আগের প্লাইস্টোসিন যুগের একটি উদ্ভিদকে তারা পুনর্জীবিত করেছিল।
সাদা রঙের ফুল হওয়া এই উদ্ভিদের নাম সিলিন স্টেনোফিলা। গবেষকদের মতে, গাছপালা হলো পৃথিবীব সবচেয়ে প্রাচীন বহুকোষী প্রাণ।
গবেষক দল পারমাফ্রস্টের ৪০ মিটার নিচ থেকে উদ্ভিদের অপরিপক্ব ফলের টিস্যু উদ্ধার করে। সেই টিস্যু থেকে বিজ্ঞানীরা ফুল ও ফল আনতে সক্ষম হন। এমনকি এই উদ্ভিদের পরবর্তী প্রজন্মও চালিয়ে যাওয়ার মতো কার্যকর বীজও তৈরি করতে সক্ষম হয়।
১ হাজার ৫০০ বছরের পুরোনো শ্যাওলা থেকে নতুন শ্যাওলার জন্ম
রাশিয়ান বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ান পারমাফ্রস্ট থেকে ফুলের উদ্ভিদ পুনরুত্পাদন করার মাত্র দুই বছর পরে, ব্রিটিশ গবেষকদের একটি দল বিশ্বের অন্য প্রান্ত এন্টার্কটিকায় ১ হাজার ৫৩০ বছর আগে চাপা পড়া শ্যাওলার খোঁজ পায়।
যা ক্রিপ্টোবায়োসিসের মাধ্যমে বরফের মধ্যে জমাট বেঁধেছিল, এই পদ্ধতিতে একটি কোষের বিপাকীয় কার্যাবলি বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণত হিমবাহের মতো কঠিন পরিবেশে নিজের বাঁচাতে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণী ক্রিপ্টোবায়সিসে প্রবেশ করে জীবগুলো শুধু হিমায়িত পারমাফ্রস্টের মতো অত্যন্ত কঠোর পরিবেশ থেকে নিজেদের বাঁচাতে ক্রিপ্টোবায়োসিসে প্রবেশ করে।
সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো গবেষকরা প্রাচীন শ্যাওলাগুলোতে নতুন শ্যাওলা জন্মাতে সক্ষম হয়েছেন।
গুটি বসন্তের হারিয়ে যাওয়া প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনা
২০১৭ সালে আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক সিন্থেটিক বায়োলজিই ব্যবহার করে হর্সপক্স ভাইরাসের নতুন জিনোম তৈরি করেন। একে মারাত্মক গুটি বসন্তের কাজিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তবে মানুষের জন্য ভাইরাসটি ক্ষতিকর নয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, সম্ভবত ভাইরাসটি প্রকৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, এই ধরনের প্রযুক্তি যদি ভুল হাতে পড়ে, তাহলে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে। কেউ খারাপ উদ্দেশে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করলে কোটি মানুষের মৃত্যু সম্ভব। কারণ গুটি বসন্তের জীবাণু অত্যন্ত সংক্রামক ও প্রাণঘাতী ভাইরাস।
জার্মানির মিউনিখের লুডভিগ ম্যাক্সিমিলিয়ান ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট গার্ড সাটার এই বিষয়ে একটি বিজ্ঞান নিবন্ধে বলেছেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই। যদি হর্সপক্সের সঙ্গে এটি সম্ভব হয়, তবে গুটি বসন্তের সঙ্গে এটি সম্ভব।’
গুটি বসন্তের ভাইরাস হলো পৃথিবীর একমাত্র ভাইরাস। যেটিকে ১৯৭৭ সালে টিকা দেয়ার মাধ্যমে বিশ্ব থেকে নির্মূল করা হয়েছিল।
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ