ভারতে ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে বলে বিবৃতি প্রকাশ করেছে ইসলামিক কো-অপারেশন। করোনা সংক্রমণ এবং লকডাউনকে কেন্দ্র করে ভারতে মুসলিমবিদ্বেষ বা ইসলামোফোবিয়া বাড়ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
এরই ধারাবাহিকতায় মুসলিমদের সঙ্গে সব ধরনের লেনদেন বয়কট করতে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়েছে ভারতের ছত্তিশগড়ের সুরগুজা জেলার একটি গ্রামের বাসিন্দাদের। গত বুধবার নেওয়া বিতর্কিত ওই শপথের বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
শপথে বলা হয়, ‘আমরা হিন্দুরা মুসলিম দোকানদারের কাছ থেকে কোনো কিছু কিনব না। তাদের কাছে আমাদের জমি বিক্রি অথবা ভাড়া দেব না। পারিশ্রমিকের বিনিময়েও আমরা তাদের শ্রমিক হিসেবে কাজ করব না।’
ভিডিওতে কুন্দিকালা গ্রামবাসীকে শপথ নিতে দেখা গেলেও কারা শপথ পড়াচ্ছিলেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ, স্থানীয় ছত্তিশগড়ি ভাষার বদলে হিন্দিতে শপথবাক্য পাঠ করানো হচ্ছিল।
পুলিশ জানিয়েছে, যে এই শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, তাকে চিহ্নিত করা গেছে। কোনো ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার যোগসাজশ পাওয়া যায়নি।
পুরো ঘটনায় বিজেপি অথবা আরএসএসের কোনো কর্মীকে দেখা না যাওয়ায় ঘটনাটিকে সাম্প্রদায়িক কোনো ছকেও ফেলা যাচ্ছে না।
বছরের প্রথম দিন পার্শ্ববর্তী গ্রাম আরা থেকে কয়েকজন তরুণ কুন্দিকালা গ্রামে পিকনিক করতে আসে। সে সময় স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়।
এরপর ইলিয়াস নামে একজনের নেতৃত্বে আরা গ্রাম থেকে ১০ জনের একটি দল কুন্দিকালা গ্রামে এসে স্থানীয় বীরেন্দ্র যাদবের বাড়িতে হামলা করে। ঘটনার পরপরই পুলিশ হামলাকারী সবাইকে গ্রেপ্তার করে।
দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু-মুসলিম বিভাজন ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। হাসপাতাল থেকে নেতা-মন্ত্রীদের বিবৃতি, সর্বত্রই বিভাজন দেখা যাচ্ছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যেও বিভাজনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।
ভারতে গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে ধর্মীয় স্বাধীনতা
গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে ধর্মীয় স্বাধীনতা লঙ্ঘনের অভিযোগে ভারত, রাশিয়া, ভিয়েতনাম ও সিরিয়াকে কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ জানিয়েছে।
এর মধ্যে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন ও বৈষম্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করে বলা হয়, প্রথম চারটি দেশকে ‘বিশেষ উদ্বেগের দেশ’ (সিপিসি) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন।
কমিশনের এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা পরিস্থিতি নেতিবাচক অভিমুখ অব্যাহত রেখেছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশটিতে হিন্দু জাতীয়তাবাদ প্রচার করেছে, যার কারণে সেখানে নিয়মতান্ত্রিক, চলমান ও গুরুতরভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন হয়েছে।
তার আগের বছর দিল্লির দাঙ্গায় মুসলিমদের বিরুদ্ধে পুলিশি দমন-পীড়নের অভিযোগ এবং মোদির নেতৃত্বে নাগরিকত্ব আইন বিষয়ক উদ্বেগ অব্যাহত থাকার কথাও প্রতিবেদনে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে মার্কিন কমিশন।
গো-হত্যার নামে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ করেছে। এর ফলে প্রাণহানি পর্যন্ত হয়েছে। ধর্মীয় স্বাধীনতা আরও বেশি ক্ষুণ্ণ হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারতের ১০ রাজ্যে।
এর মধ্যে রয়েছে, উত্তরপ্রদেশ, অন্ধ্রপ্রদেশ, বিহার, ছত্তীশগড়, গুজরাট, ওড়িষ্যা, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থান।
উল্লেখ্য, ইন্দোনেশিয়ার পর ভারতেই মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি৷ দেশটিতে এখন প্রায় সাড়ে ১৯ কোটি মুসলিমের বাস৷
পিউ রিসার্চ সেন্টারের করা এক গবেষণা দেখা গেছে ২০৬০ সালের মধ্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩০ কোটিরও বেশি৷ অর্থাৎ মাত্র দুই জেনারেশন পরেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইসলাম ধর্মাবলম্বীর দেশ হবে ভারত৷
মোদির প্রথম শাসনামলে মুসলিমবিরোধী সহিংসতা উগ্র রূপ নিয়েছিল, এ নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই৷ গরুর মাংস খাওয়ার অভিযোগে অন্তত ৪০টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ এই ঘটনাগুলোর বেশিরভাগেরই কোনো বিচারও হয়নি৷ ফলে সংখ্যালঘুদের ‘চাইলেই নির্যাতন করা যায়’, এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে৷
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের মতো মৌলিক কিছু বিষয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, যা গণমাধ্যমেও ঠিকমতো আসেনি৷ এই বৈষম্য সবসময়ই ছিল, কিন্তু বিজেপির অধীনে তা ভারতের মাটিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে৷
এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে নিজেদের অবাঞ্ছিত মনে করার এক ধরনের প্রবণতা তৈরি হয়েছে৷ বিশেষ করে উত্তর ভারতে মুসলিমরা নিজেদের ভিটেমাটিতেই আর নিরাপদ বোধ করেন না৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৫৪০
আপনার মতামত জানানঃ