পরিবেশ ডিএনএ বিষয়ক গবেষণা জোর কদমে এগিয়ে চলেছে গত দুই দশকে। তবে তার বেশিরভাগই হয় জলা অঞ্চলে। আর পানির তুলনায় বাতাসে ডিএনএ নিয়ে কাজ করা কঠিন, কারণ এখানে ডিএনএ পাওয়া যায় কম পরিমাণে এবং অগোছালোভাবে।
পানিতে যেহেতু আগে থেকেই পদ্ধতিটি সাফল্য দিচ্ছিল, তাই বিজ্ঞানীরা এবার ঝুঁকলেন বাতাসের দিকে। নতুন এই পদ্ধতি দুটি চিড়িয়াখানায় ইতিমধ্যে পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রকৃতিতে জীববিদ্যাবিষয়ক গবেষণায় নতুন দরজা খুলে দিতে পারে
গত বছরের ঘটনা। জিনতত্ত্ববিদ এলিজাবেথ ক্লেয়ার ছোট ছোট ৭০টি ফিল্টার রাখলেন ইংল্যান্ডের হ্যামারটন জু পার্কে। তিনি চাইছিলেন বাতাস থেকে ডিএনএ (ইডিএনএ) সংগ্রহ করতে।
প্রায় একই সময়ে ৫০০ মাইল দূরের কোপেনহেগেন চিড়িয়াখানাতেও একই রকম পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন আরেকদল বিজ্ঞানী। কোপেনহেগেনের দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ক্রিস্টিন বোহম্যান। তিনি কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোব ইনস্টিটিউটের জিনোমবিজ্ঞানী।
বিস্ময়করভাবে সফল হয় দুই দলই। ওই চমৎকার সাফল্যের খবর গেল ৬ জানুয়ারি প্রকাশ হয়েছে কারেন্ট বায়োলজিতে।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, সংগৃহীত ডিএনএ দেখে বিভিন্ন প্রাণী প্রজাতির উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে। পদ্ধতিটির বড় সুবিধা হচ্ছে এটি আক্রমণাত্মক (মানে কোনো প্রাণীকে ধরে কিছু করার দরকার হয় না) নয়। বিরল, আক্রমণাত্মক এবং খুঁজে পাওয়া কঠিন এমন সব প্রাণী চিহ্নিত করতে এই পদ্ধতি খুব কাজের হবে। আবিস্কারের কৃতিত্ব কিন্তু একইসঙ্গে দুটি গবেষকদলকেই দেওয়া হচ্ছে।
সাধারণত বন্যপ্রাণী গবেষণায় ‘দেখা’ পদ্ধতিই বেশি ব্যবহৃত হয়। আরেকটি যে পদ্ধতি আছে, তা হলো ইনডিরেক্ট। মানে প্রাণীরা পেছনে যা রেখে যায়—পশম, পালক বা পায়ের ছাপ—তা দেখে গবেষণা করা।
বিশেষ করে যখন ছোট, লাজুক অথচ দ্রুতগামী প্রাণীদের দেখা পাওয়া ভার তখন পালক বা পশম হয় গবেষকের সম্বল। আবার পায়ের ছাপ দেখে বাঘ কি বাঘিনী, ওজন, আকার, বয়স গবেষণা তো মশহুর।
নতুন পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা
জীবিত সকল প্রাণীই প্রকৃতিতে ডিএনএ ছড়ায়। গবেষকরা আশাবাদী, বাতাস থেকে সংগৃহীত ডিএনএ দিয়ে তারা নির্দিষ্ট এলাকায় কোন কোন প্রাণীর বিচরণ, তা বুঝতে পারবেন।
ক্লেয়ার বলছিলেন, ‘হাঁ এটি একটি পাগল পাগল ভাবনা। আসলে আকাশ থেকে ডিএনএ টেনে আনছি বললে কে অবাক হবে না?’
এই পদ্ধতির অসুবিধাও আছে কিছু। এ বিষয়ে ক্লেয়ার বলেন, একাধিক প্রাণীর ডিএনএও জটলা করে ভেসে বেড়ায়। তখন বিভ্রান্তি বাড়ে। তাছাড়া যখন ৭টি ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে ক্রস চেক করা হয়, তখনও তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে।
সেক্ষেত্রে ন্যাশনাল পার্ক বা চিড়িয়াখানা থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করে নিশ্চিত হওয়া বরং সহজ। আরেকটি মজার সমস্যার কথা বলি। যেমন আমার গবেষণাগারে বাঘের কোনো ডিএনএ নমুনা নিই, যদি আমি বাঘের ডিএনএ সংগ্রহও করে ফেলি বাতাস থেকে, তবুও বুঝতে পারব না সেটা কার। বরং অন্য কোনো প্রাণীর ডিএনএ বলে তালগোল পাকিয়ে ফেলতে পারি।
যেভাবে করা হল এই গবেষণা
বাতাস থেকে ডিএনএ জোগাড় করতে চেয়ে দুই দলই কিন্তু ইনডোর এবং আউটডোরে ফিল্টার রেখেছিল। বোম্যানের দল কোপেনহেগেন চিড়িয়াখানার তিনটি লোকেশন থেকে সংগ্রহ করেছিল ৪০টি নমুনা। লোকেশন তিনটি হলো ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্ট হাউজ, দি ওকাপি আস্তাবল এবং আউটডোর।
তারা ফিল্টারের সঙ্গে ভ্যাকুয়ার ক্লিনার আর ব্লোয়ারও রেখেছিলেন। থুতু, বিষ্ঠাও ধরা পড়েছিল তাদের ফাঁদে। তারপর সেগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন গবেষণাগারে।
পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন, অর্থাৎ পিসিআর টেকনিক প্রয়োগ করে ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করেছেন। তারপর তারা পাবলিক ডেটাবেইজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছেন।
৪০টি নমুনা থেকে বোম্যান কোপেনহেগেন চিড়িয়াখানায় ৪৯টি প্রজাতির উপস্থিতি নিশ্চিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ আর মাছও আছে।
বোম্যান বলছিলেন, আমরা এতটা সফল হব, ভাবিওনি। যখন ফলাফল দেখলাম, বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। আমরা হাসতে হাসতে কেঁদে ফেলেছিলাম প্রায়।
চিড়িয়াখানার বাইরের দুটি প্রাণীর ডিএনএও ধরা পড়েছিল আমাদের ফাঁদে। তার একটি হলো ওয়াটার ভোল (জলের ইঁদুর নামে চেনে অনেকে) অন্যটি লাল বেজি।
ক্লেয়ারের দল দুই ডজন প্রজাতি খুঁজে পেয়েছিল নমুনা থেকে। এর মধ্যে ডিঙ্গো (একরকম বন্য কুকুর) আর লেমুরও আছে। আসলে কিন্তু শুরুর সময়ে দল দুটির কারুরই ফলাফল সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
রোম্যান বলেন, শেষে আমরা যখন ভালো ফল পেলাম, দুদল মিলেই গবেষণাপত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নিলাম। এটি তো সত্যি অদ্ভুত, দুটি ভিন্ন দল দুই ভিন্ন জায়গায় একই গবেষণা একই সময়ে চালাচ্ছিল। বস্তুতই এটা একটা দুর্লভ সুবিধা।
টেক্সাস টেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্ক জনসনও বলছিলেন, এটা অদ্ভুত ব্যাপারই বটে, দুটি ভিন্ন দল একই গবেষণা কাজে ভালো সাফল্য পেয়েছে। তবে খোলা প্রকৃতিতে (তৃণভূমি যেমন) পদ্ধতিটি কাজে লাগানোর আগে সবাইকেই বেশ খাটতে হবে।
গুহায় আবার কাজ করতে গেলে আরো অন্যরকম ভাবতে হতে পারে। তাই অপেক্ষা করছি খোলা প্রকৃতিতে ফল কেমন দাঁড়ায় তা দেখতে।
ক্লেয়ার বলছিলেন, দুর্গম জায়গায় ইডিএনএ পদ্ধতি বেশি কাজের হতে পারে, যেমন গিরিখাদ, গুহা ইত্যাদি। সুইজারল্যান্ডের ইডিএনএ গবেষক ফাবিয়ান রজার আবার আগ্রহী পদ্ধতিটি পোকামাকড়ের ওপর কেমন কাজ করে, তা জানতে।
ফাবিয়ান বলছিলেন, না ধরে বা হত্যা না করে তাদের সম্পর্কে জানার সুযোগ আমরা কম পাই। তবে ফাবিয়ান একে প্রচলিত পদ্ধতির বিকল্প ভাবেন না, বরং গবেষণার একটি নতুন টুল বলেই ভাবছেন। জীববৈচিত্র্য গবেষণা আসলে ব্যক্তিবিশেষের নয়, সবাইকে মিলেমিশেই এখানে কাজ চালিয়ে যেতে হয়।
বনহ্যাম বা ক্লেয়ার কিন্তু নিশ্চিত নন, ইডিএনএ দিয়ে নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটি প্রজাতির সব প্রাণীর সংখ্যা বোঝার সুযোগ হবে কি-না। বিজ্ঞানীরা আরো জানতে চাইছেন, প্রকৃতিতে কতক্ষণ ডিএনএ সতেজ থাকে আর প্রাণীটি ততক্ষণ নির্দিষ্ট স্থানে থাকে কি না যতক্ষণ ইডিএনএ দিয়ে তার সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
এসব অনেক প্রশ্ন সামনে রেখেই এগুচ্ছেন ক্লেয়ার আর বনহ্যাম। তারা আশাবাদীও বটে, পদ্ধতিটি জীববৈচিত্র্য গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৫০
আপনার মতামত জানানঃ