পৃথিবী জুড়েই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। যার ফলে শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে।
২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশকে রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের একটি সনদে স্বাক্ষর করে ওই ঘোষণা দেয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
২০১১ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সনদ (সিবিডি) অনুযায়ী ওই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। এসব দেশের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
দক্ষিণ এশিয়ার রক্ষিত বনের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে এ চিত্র। বিজ্ঞান সাময়িকী সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্ট–এ প্রতিবেদনটি চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষণায় বলা হয়, ২০১১ সালে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্যবিষয়ক সনদ (সিবিডি) অনুযায়ী ওই লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে। এসব দেশের মধ্যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপে রক্ষিত বনের পরিমাণ ৫ শতাংশের নিচে। বাংলাদেশ ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশের মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকাকে রক্ষিত বন করতে পেরেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে এগিয়ে আছে ভুটান, দেশটির রক্ষিত বন ৪৯ শতাংশ ৬৭ শতাংশ। ভারতে রক্ষিত বন ৭ শতাংশ ৫২, শ্রীলঙ্কায় ২৯ শতাংশ ৮৯, পাকিস্তানে ১২ শতাংশ ৩১, নেপালে ২৩ শতাংশ ৬৩, মালদ্বীপে ২ শতাংশ ৩ ও আফগানিস্তানে ৩ শতাংশ ৬৪ শতাংশ।
প্রকৃতিবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউটের ২০২২ সালের জানুয়ারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ এলাকা রক্ষিত বনভূমি। আর জলভাগের ৭ দশমিক ৯২ শতাংশ এলাকা রক্ষিত অবস্থায় আছে। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও আফ্রিকার বেশির ভাগ দেশ রক্ষিত বনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে এশিয়ার দেশগুলো।
গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশের রক্ষিত এলাকার ১ শতাংশের কম জায়গা কার্যকর ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা গেছে। বাকি এলাকায় বন্য প্রাণী হত্যা ও পাচার, বৃক্ষ ধ্বংস করাসহ মোট ১৪ ধরনের সমস্যা রয়ে গেছে। রক্ষিত এলাকাগুলোর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা থাকলে একে প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার (আইইউসিএন) সবুজ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রক্ষিত বন এখন পর্যন্ত ওই তালিকায় যুক্ত হতে পারেনি। সিবিডি থেকে ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট ভূখণ্ডের ৩০ শতাংশ এলাকাকে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশে রক্ষিত বন রক্ষার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৩০–এর মধ্যে আগের লক্ষ্যমাত্রাই পূরণ সম্ভব নয় বলে মনে করছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। এ জন্য বনভূমিগুলোকে পর্যায়ক্রমে রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা এবং তা সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এ জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও তহবিল দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তাঁরা।
গবেষণায় বাংলাদেশে রক্ষিত বনভূমিগুলোর একটি সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি হলো এসব বনভূমির বেশির ভাগের অবস্থান একই অঞ্চলে। মূলত দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ম্যানগ্রোভ বন ওই রক্ষিত বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রক্ষিত বনাঞ্চল আয়তনে এতটাই ছোট যে তা জীববৈচিত্র্য ধারণের জন্য অপ্রতুল।
গবেষণায় বলা হয়, প্রায় ১৪ ধরনের হুমকির সম্মুখীন এসব বনের জীববৈচিত্র্য। যার মধ্যে বন উজাড় সবার ওপরে। আর সবার নিচে রোগব্যাধির কারণ।
২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট ভূখণ্ডের ১৭ শতাংশকে রক্ষিত বনাঞ্চল করার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখতে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জাতিসংঘের একটি সনদে স্বাক্ষর করে ওই ঘোষণা দেয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
এদিকে ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউএমও) গবেষণা থেকে জানা যায়, গত ২৭ বছরে বাংলাদেশ তার শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চলের ১৯ শতাংশই হারিয়ে ফেলেছে।
ডব্লিউএমওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের মোট ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের তিন-চতুর্থাংশই এশিয়ায়। এর মধ্যে বাংলাদেশে ২৪ শতাংশ। মিয়ানমারে ১৯, ভারতে ১৭ ও থাইল্যান্ডে রয়েছে ১৪ শতাংশ।
তবে বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের অবস্থা দিন দিন বেশ নাজুক হয়ে উঠছে। সূত্র মতে, ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিসর ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যেই ১৯ শতাংশ কমে গেছে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, চরম আবহাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির কারণে ২০২০ সালে এশিয়ায় হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, আর বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখো মানুষ। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে শত শত কোটি ডলারের। বহু অঞ্চলের সার্বিক অবকাঠামো ও বাস্তুতন্ত্র একেবারে ভেঙে পড়েছে।
এই গবেষণা এমন এক সময় পরিচালনা করা হয়েছে, যখন গোটা বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারিতে আক্রান্ত। এই মহাদুর্যোগে আবার একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দিয়েছে এশিয়ার দেশগুলোয়। সঙ্গে ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পড়া দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব। এর মধ্যে রয়েছে হিমবাহের গলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো।
একদিকে কোভিড মহামারি, অন্যদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ এশিয়াকে বারবার পর্যুদস্ত করেছে। ২০২০ সালের মে মাসে ভারত ও বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের ওপর দিয়ে গেছে এই অঞ্চলের এ যাবৎকালে হওয়া সবচেয়ে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এমন বহু ঝড়কে বুক দিয়ে ঠেকাতে ঠেকাতে সুন্দরবনও তার শক্তি হারাচ্ছে ক্রমশ।
এর সঙ্গে রয়েছে মানবসৃষ্ট আরও নানা কারণ। সব মিলিয়ে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট নানা কারণে সুন্দরবনের মতো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। বিশেষত সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ নিয়ে অনেক আগে থেকেই উদ্বেগ জানিয়ে আসছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ বিষয়ে সতর্ক হয়নি বাংলাদেশ।
পার্বত্য এলাকায় রয়েছে চার ধরনের বন-সংরক্ষিত, রক্ষিত, ব্যক্তিমালিকানাধীন ও অশ্রেণিভুক্ত। তবে বনের বেশিরভাগই অশ্রেণিভুক্ত। কাজেই বন উজাড়করণের ফলে ওই এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। বৃক্ষ মাটির ক্ষয় রোধ করে পাহাড়ের ভিতকে দৃঢ় রাখে। নির্বিচারে গাছ কাটার ফলে আসন্ন বর্ষায় পাহাড়ি রাস্তা ধসে পড়ার আশঙ্কা বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বন বিভাগের উচিত অবিলম্বে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ওপর বন বিভাগের নজরদারি বাড়লেও দুর্গম এলাকা হওয়ায় এদিকে তেমন তদারকি নেই। ফলে বনখেকোরা বিনা অনুমতিতে কেটে নিয়ে যাচ্ছে বনের গাছ। বস্তুত কয়েক দশক ধরেই চলছে এ প্রক্রিয়া। এভাবে চলতে থাকলে একসময় এ পাহাড়ি এলাকায় বনাঞ্চল বলে আর কিছু থাকবে না। কাজেই পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত। রক্ষা করতে হবে পাহাড়ি বনাঞ্চল।
এছাড়া বন ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন হচ্ছে পশু-পাখির আশ্রয়স্থল। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য। দেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বনাঞ্চল অনেক কম। এশিয়ার অনেক উন্নয়নশীল দেশ অথবা পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ এখনো যুগোপযোগী ও কল্যাণকর বন আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে।
শিল্পোন্নত দেশ জাপানের ভূখণ্ডের শতকরা ৭০ ভাগ এবং জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়ার ৫০ ভাগ ভূখণ্ড বনে আচ্ছাদিত। সঠিক, বাস্তব ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমাদের দেশেও বন সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তারা বলেন, এজন্য নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। দেশে যে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা করা হয়েছিল, সেটির ফলাফল আশাব্যঞ্জক নয়। গত শতকের আশির দশকে সামাজিক বনায়নের ভুল ও অপরিকল্পিত বাস্তবায়নের কারণে দেশের ‘শালবন’ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। কাজেই দেশের বনাঞ্চল রক্ষায় একটি যথোপযোগী বন আইন প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন জরুরি।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৭২৬
আপনার মতামত জানানঃ