এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে মানুষ জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুমের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে জাতিসংঘের। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের কাছে জবাব চাইছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়ার্কিং গ্রুপ অন এনফোর্সড অর ইনভলান্টারি ডিজ-অ্যাপিয়ারেন্স।
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে জোরপূর্বক নিখোঁজ বা গুমের বিষয়ে জাতিসংঘকে সন্তুষ্টজনক জবাব দিতে চায় বাংলাদেশ। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা, ধারণা, ব্যবস্থা ও প্রতিবেদন প্রতিরোধে উদ্যোগ নিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
জাতিসংঘকে সন্তুষ্ট করতে চায় বাংলাদেশ
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও এর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর বাংলাদেশে গুম নিয়ে ডব্লিউজিইআইডিকে সন্তুষ্ট করতে প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিত সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। এ জন্য গদবাধা জবাবের বাইরে এসে কেস টু কেস ডিটেইলিং বা গ্রাউন্ড রিয়েলিটি এক্সপ্লেইনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার বাংলাদেশের কাছে ডব্লিউজিইআইডির প্রশ্নের বিষয়ে তাদের অবগত করা নিয়ে আন্তমন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়।
এতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয় ছাড়াও পুলিশ, র্যাবসহ সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পশ্চিম) সাব্বির আহমেদ চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক বা অনিচ্ছাকৃত গুম নিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশের কাছে যা জানতে চেয়েছে, সে বিষয়ে তাদের অবগত করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা।’
গত এক দশকে বাংলাদেশের কাছে ৮৩ জনের গুম হওয়া নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চেয়েছে ডব্লিউজিইআইডি। এ নিয়ে আগে বৈঠক করে জাতিসংঘকে উত্তর দিয়েছে বাংলাদেশ। তবে কোনোবারই জাতিসংঘ বাংলাদেশের উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাই বিষয়টি এবার গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে বাংলাদেশ।
ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনে
সামনে ডব্লিউজিইআইডির বৈঠক হবে। এরপরই রয়েছে ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ। তার আগেই জাতিসংঘকে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোতে সন্তুষ্ট করতে চায় ঢাকা।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেকটি সূত্র জানায়, জাতিসংঘকে বাংলাদেশ যে উত্তর দিয়েছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তবে কেন সন্তুষ্ট হয়নি, তার বিস্তারিতও বলেনি।
জাতিসংঘের এ প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তাই সভায় উপস্থিত সংশ্লিষ্টদের গতানুগতিক ব্যাখ্যা থেকে বের হয়ে সঠিক ও ‘গ্রাউন্ড রিয়ালিটি’ দিতে বলা হয়েছে।
সূত্রটি বলেছে, বাংলাদেশ নিয়ে জাতিসংঘের নেতিবাচক প্রতিবেদন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। ফলে বাংলাদেশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর বিষয়ে বিরূপ মনোভাব জন্ম নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অংশগ্রহণে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
তাই আগে থেকেই বিষয়টিতে প্রতিকারমূলক প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ও ক্ষতি কীভাবে ঠেকানো যায়, তা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।
২০১৯ সালে ডব্লিউজিইআইডির প্রতিবেদনে গুম প্রশ্নে বাংলাদেশ নিয়ে বেশ নেতিবাচক তথ্য তুলে ধরা হয়। সেখানে বলা হয়, জোরপূর্বক নিখোঁজ হওয়া থেকে সব নাগরিককে সুরক্ষা দেয়ার যে ঘোষণা, তা লঙ্ঘন এবং এই ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যর্থতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে গুম অব্যাহত আছে বলে উল্লেখ করা হয়। সেই সঙ্গে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে ৫০৭ জন জোরপূর্বক নিখোঁজ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৬২ জন নিহত হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে ২৮৬ জন ফিরে এলেও ১৫৯ জনের কোনো খোঁজ এখনও মেলেনি।
এর আগে একই ধরনের প্রতিবেদন ২০১৭ সালে প্রকাশ করেছিল ডব্লিউজিইআইডি। এবার ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউর পর ডব্লিউজিইআইডি আবার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করবে।
আগের দুই প্রতিবেদনের মতো এমন অভিযোগের উল্লেখ করে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নামে যাতে কোনো নেতিবাচক বিষয় যাতে উঠে না আসে, সে বিষয়ে ঢাকা এবার বিশেষভাবে সচেতন।
গত বছরের বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ৩৪ জন ব্যক্তির অবস্থান ও ভাগ্য জানতে চেয়ে বাংলাদেশের কাছে চিঠি দিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল।
ডব্লিউজিইআইডি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছিল। সেই চিঠির সূত্র ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০২১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি পুলিশের বিশেষ শাখা এসবিতে একটি চিঠি পাঠায়।
র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনে জাতিসংঘের অবস্থান
জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিষয়ে মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগসমূহ যেন তাদের মোতায়েনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত হয় — তা পর্যাপ্তভাবে নিশ্চিতে এই প্রক্রিয়া নিয়মিতভাবে হালনাগাদ করার কথা জাতিসংঘের।
র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে যেহেতু জাতিসংঘের বিভিন্ন মানবাধিকার সংক্রান্ত কাঠামো থেকে উদ্বেগ উঠেছে, তাই এসব উদ্বেগ প্রাসঙ্গিকভাবে বিবেচ্য একটি বিষয়।
এ প্রসঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর থেকে নির্দিষ্টভাবে ২০১৯ সালে প্রণীত জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী কমিটির একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নে কাজ করেছেন এমন সৈন্য বা পুলিশ সদস্যদের প্রতিনিয়তই জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হয়েছে বলে যেসব তথ্য বা প্রতিবেদন রয়েছে, তা নিয়ে [কমিটি] উদ্বিগ্ন।
শ্যামদাসানি আরও উল্লেখ করেন, বলপূর্বক বা অনৈচ্ছিক অন্তর্ধান (গুম) বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ সরকারের কাছে চিঠি লিখে নিজেদের উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করেছে।
এতে লেখা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটনে র্যাব সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ সম্পর্কে কোনো তদন্ত কিংবা পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাইবাছাই ছাড়াই র্যাবের সদস্যরা জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে বলে ওয়ার্কিং গ্রুপ উদ্বিগ্ন।
নেত্র নিউজ জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের কাছে জানতে চেয়েছিল গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত থাকার দায়ে র্যাব ও সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে কী কী প্রভাব পড়তে পারে। তারই জবাবে রাভিনা শ্যামদাসানি তার বক্তব্য দেন।
তার প্রতিক্রিয়া থেকে ইঙ্গিত মিলছে যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা শান্তিরক্ষী কর্মসূচিতে সরাসরি প্রভাব না ফেললেও, জাতিসংঘের এ সংক্রান্ত নিজস্ব প্রতিবেদন নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শ্যামদাসানি বলেন, জাতিসংঘে কাজ করার ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে তার দেশের সরকার মনোনয়ন দিলে, তাকে যাচাই-বাছাইয়ের মূল দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের।
তবে তিনি যোগ করেন, সরাসরি অংশ নেয়া বা (জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বা কমান্ডার হিসেবে) নিবৃত্ত করতে ব্যার্থ হওয়ার মাধ্যমে কোনো ব্যাক্তি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা মানবতা সংক্রান্ত আইন লঙ্গণে জড়িত রয়েছেন বলে বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ প্রতিষ্ঠা করে এই ধরণের তথ্য বা অভিযোগ কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে জাতিসংঘ বিভিন্ন প্রক্রিয়া ঠিক করেছে। এর ফলে ওই ব্যক্তি যোগ্যতা, কার্যকারিতা ও ন্যায়নিষ্ঠতার সর্বোচ্চ মানদণ্ড পূরণ করবেন না; তার অর্থ হলো, ওই ব্যক্তিকে শান্তিরক্ষার সেবায় নির্বাচন বা মোতায়েন করা সঠিক হবে না।
তিনি যোগ করেন, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তরের ভূমিকা হলো, আমরা জাতিসংঘ সচিবালয়ের অনুরোধ অনুযায়ী নির্বাচন, নিয়োগ, মনোনয়ন, মোতায়েন বা চুক্তি সম্পাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন প্রণালীতে তথ্য দিয়ে থাকি। ব্যক্তিবিশেষ বা সম্ভাব্য সদস্য দলের মানবাধিকার সংক্রান্ত কর্মকান্ড বিষয়ক তথ্য এসব ধাপে আমলে নেয়া হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়।
তার প্রতিক্রিয়ায় শ্যামদাসানি জাতিসংঘের নির্যাতন-বিরোধী কমিটি ও গুম বিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটির প্রতিবেদনসমূহকে বিশদভাবে উদ্ধৃত করেন, যেখানে র্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিস্তর অভিযোগ বর্ণনা করা হয়েছে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ