আসন্ন বর্ষা মৌসুমের আগেই নিজস্ব অর্থায়নে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসির) আওতাভুক্ত ১১টি খাল দখলমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এগুলো পরিষ্কার করে পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির কাজ শুরু করা হবে। খাল উদ্ধারে মেয়রের এমন শক্ত ঘোষণায় নগরবাসীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। কিন্তু এই বর্ষার আগেই মেয়রের প্রতিশ্রুতি পালন অম্ভব কিনা, এ নিয়ে রয়েছে অবিশ্বাস, সন্দেহ। অবশ্য কথার কথা না বলে নেতার কাজের কাজ করবেন বলে প্রত্যাশা নাগরিকদের।
১ ডিসেম্বর ২০২০ মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর শ্যামপুর খাল পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে মেয়র শেখ তাপস বলেন, খাল পুনরুদ্ধারে আমরা স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম হাতে নিচ্ছি। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রম আমরা নিজ অর্থায়নে আরম্ভ করে দিচ্ছি। ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে (সিএস) দেখে আমরা সীমানা নির্ধারণ করব। খালগুলো দখলমুক্ত করব। খালের মধ্যে যেসব বর্জ্য রয়েছে তা আমরা অপসারণ করব। জলপ্রবাহ ঠিক করতে পারলে ঢাকার বিভিন্ন অংশে যেখানে জলাবদ্ধতা হয়ে থাকে, সেগুলো আর হবে না। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বল্পমেয়াদি কাজটা নিজস্ব অর্থায়নে করছি। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ মেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণ এবং নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য আমরা কাজটি সম্পন্ন করব।জনগণের সহযোগিতা থাকলে ঢাকাবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করতে পারবেন বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন মেয়র।
মেয়র তাপস এ সময় আরো বলেন, ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতার একটি মূল কারণ হলো ঢাকার মধ্য দিয়ে যে খালগুলো প্রবাহিত, সেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বদ্ধ হয়ে গেছে। ভূমিদস্যুরা যেমনি এগুলো দখল করেছে, তেমনি খালগুলোর সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। কিছুদিন আগেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর নেতৃত্বে এ খালগুলো ওয়াসা থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন উত্তর ও দক্ষিণকে দিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় যে ১১টি খাল রয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধার, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো আমরা আরম্ভ করেছি।
বক্স কালভার্ট নিয়ে করা সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএসসিসির মেয়র বলেন, বক্স কালভার্টগুলো বিশেষ করে পান্থপথ ও ধোলাইখালের বক্স কালভার্টগুলো দীর্ঘদিন ধরে সঠিকভাবে পরিষ্কার করা হয়নি। আমরা অচিরেই সেগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ আরম্ভ করব। পরবর্তীতে আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় কি করা যায়, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে সেই কার্যক্রম হাতে নেব।
এদিকে নগরবাসীর নানা সমস্যার কথা শুনতে ‘জনতার মুখোমুখি নগরসেবক’ শীর্ষক নিয়মিত অনুষ্ঠান করে থাকে উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। করোনার কারণে সরাসরি অনুষ্ঠানের পরিবর্তে মঙ্গলবার সিটি করপোরেশনের ফেসবুক পেইজের মাধ্যমে এতে যুক্ত হন উত্তর ঢাকার মেয়র আতিকুল ইসলাম। কমেন্টে নগরবাসীর প্রশ্নগুলো মেয়রের সামনে তুলে ধরেন চিত্রনায়ক ফেরদৌস। যানজট, মশকনিধন, পরিচ্ছন্নতাসহ নানা বিষয়ে অভিযোগ ছিল নগরবাসীর। আর সমাধানের কথা জানান আতিকুল ইসলাম। সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দেন মেয়র। এ সময় আতিকুল ইসলাম জানান, রাজধানীর খালগুলো দখলমুক্ত করতে শিগগিরই অভিযান শুরু করবে ডিএনসিসি।
দুই মেয়রের দিক থেকে খাল উদ্ধারের ঘোষণা, বিশেষ করে দক্ষিণের মেয়র যেভাবে দিন-ক্ষণ বেঁধে দখলদারদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন, তাতে নগরবাসী আশান্বিত। ফেসবুকে এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রাজধানীর গেণ্ডারিয়ার অধিবাসী আবু বকর সিদ্দিক লিখেছেন, এই এলাকায় ছোট বেলায় যেরকম খাল-পানি দেখেছিলাম এখন কিছুই নেই। অনেক মেয়রই তো এলো, গেল। কিন্তু দখলদারদের পোয়াবারোই হয়েছে। এখন দক্ষিণের মেয়র শেখ পরিবারের লোক। তিনি মানুষকে একটা কথা দিয়েছেন, আশা করি রাখার চেষ্টা করবেন। কথার কথা বললে হবে না, কাজের কাজ করতে হবে। মেয়র আনিসুল হক খুব বেশি কিছু করেননি, শুধু চেষ্টা করেই তিনি মানুষের মন পেয়েছেন। এখন শেখ তাপস কী করেন, দেখার অপেক্ষায় আছি।
দিন-ক্ষণ বেঁধে খাল উদ্ধারের ঘোষণা রাজনৈতিকভাবে চমকপ্রদ হলেও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার কৌশল হিসেবে এটি খুব ভালো নয় বলে মনে করেন সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ কার্যক্রমের সঙ্গে একজন কর্মকর্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, মেয়র সাহেব অবশ্য আশাবাদী, আমারও ভরসা আছে যে, তিনি পারবেন। তবে আমার যেটা মনে হয়, দখলদাররা যদি আগেভাগে উচ্ছেদের সময় জেনে যায়, তাহলে তারা তদবিরসহ নানা ধরনের ঝামেলা পাকানোর প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ পায়। তাই খাল উদ্ধার লক্ষ্য হলে নীরবে আঘাত করতে হবে।
পরিবেশবিদ আবু নাসের খান বলেন-
[player id=2420]
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘আমরা তো নিঃসন্দেহে এটিকে সাধুবাদ জানাই। সর্বতোভাবে আমরা এতে সহায়তা করব। আমরা চাইব, তারা এটা করুক।’ তিনি যোগ করেন, ‘যদি করতে পারে তাহলে তো আরো ভালো। হুমকি দেয়ার ক্ষেত্রে খাল যেন আর দখল না হয়, সেরকম একটা বিষয় আছে। আবার তারও ও একটা মান-ইজ্জতের বিষয় আছে। হয়তো সবগুলো না করলেও কিছু তো করবে, অধিকাংশই করার চেষ্টা করবে। যদি না করে তাহলে তো তার ইমেজের ওপরে একটা প্রভাব পড়বে। সুতরাং তিনি যে কমিটমেন্ট করেছেন, এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই, আশা ধরে রাখতে চাই।
কেন খালগুলো দখল হচ্ছে, কেন এগুলো ধরে রাখা যাচ্ছে না, কেন উদ্ধারের ঘোষণাগুলো ঠিকমতো কাজ করে না, এ বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশে পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম এই সংগঠক বলেন, ‘এগুলো একদিনে দখল হয়নি, দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় হয়েছে। শুধু রাজনৈতিকভাবে নয়, আর্থিকভাবে এবং আরো নানাভাবে, এমনকি ধর্মীয়ভাবেও দখল হয়েছে। মসজিদ, মন্দির তৈরি করা হয়েছে খালগুলো দখলের জন্য। সুতরাং এটা খুবই চ্যালেঞ্জিং।’
তিনি আরো যোগ করেন, ‘পলিটিকাল ইকোনমির দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখি, জায়গার দাম এত বেশি, একটা জায়গা দখল করে যতদিন রাখতে পারে, তত লাভ। আর যদি কিছুদিন দখলে রেখে বিক্রি করে দিতে পারে তাহলে তো আরো ভালো। সুতরাং এটা কোনো সহজ প্রক্রিয়া নয়। মেয়র যে উদ্যোগ নিয়েছেন এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’
এসডাব্লিউ/এমএম/আরা/২১৪০
আপনার মতামত জানানঃ