সূর্যের উদয়-অস্তের মতো চিরন্তন সত্যে পরিণত হয়েছে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা। টানা কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় শহরের বড় অংশ। সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন পক্ষ থেকে হাঁকডাক দেওয়া হলেও কার্যত সমস্যার সমাধান হয় না।
শনিবার ( ৫ জুন) সকাল থেকে রাজধানীতে ৫৫ মিলিমিটার বৃষ্টিতে মিরপুর, ধানমন্ডি, রামপুরা, বাড্ডা, উত্তরা, মগবাজার, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় যানজটের। এতে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। এর আগে গত ১ জুন প্রায় তিন ঘণ্টার বৃষ্টিতে তীব্র জলজটের সৃষ্টি হয় রাজধানীতে।
ঢাকার জলাবদ্ধতা দূর করতে বর্তমান সরকার গত দুই মেয়াদে দুই হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এই মোটা অংকের টাকার প্রকল্প ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) বাস্তবায়ন করলেও কার্যত এর কোনো সুফল পায়নি নগরবাসী। মূলত চার সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় না থাকায় একই কাজ করা হচ্ছে বারবার। প্রকল্প বাস্তবায়নে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ঘাটতি আর সমন্বয়ের অভাবেই ঢাকার জলবদ্ধতা আটকে আছে বলে অভিযোগ ওঠেছে।
জলবদ্ধতা নিরসনে ২০০৯ সাল থেকে গত এক দশকে সরকারের চারটি সংস্থা মোট ১ হাজার ৯৯৬ কোটি খরচ করেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ না কারায় বিপুল অংকের এই টাকা নর্দমা নির্মাণ ও মেরামত, পাম্পস্টেশন খাল-বক্স কালভার্ট খনন ও পরিষ্কার করার মতো ছোটখাটো কাজে ব্যয় করা হয়েছে । ফলে সাময়িক অসুবিধা দূর হলেও রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এই টাকা কোনো কাজে লাগেনি।
জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ
প্রতি বছরই জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরীর অলিগলি ও ছোট পরিসরের রাস্তাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকায় দ্রুত পানি নামতে পারে না, ফলে প্রতিবারই এমন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। সামান্য বৃষ্টিতেই মতিঝিল, গুলিস্তান, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মালিবাগ, রামপুরা, পুরান ঢাকা, খিলক্ষেতসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা মাহমুদুল হাসান বলেন, প্রতি বর্ষা মৌসুমে আমাদের সড়কে হাঁটু সমান পানি থাকে। এবার যখন ঢাকার সব খাল নালার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে দেওয়া হলো তখন সিটি করপোরেশনের মেয়ররা জলাবদ্ধতা নিরসনের নানা উদ্যোগের কথা জানান। কিন্তু গত ১ জুন আর আজকের বৃষ্টিতে তাদের সব কথা ভেসে গেছে। তারা শুধু আশা জাগিয়েছিলেন। এখন আরও সময় চাচ্ছেন তারা।
কেন মিলছে না মুক্তি?
ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। আর শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীনে ও প্রায় ২ হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি করপোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপিয়ে আসছিল। কিন্তু গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।
ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর খালগুলো দখল করে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ শুরু হয়। পাশাপাশি খালগুলোর শাখা-প্রশাখা, বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যা পুরোপুরি শেষ হতে আরও সময় লাগবে বলে দাবি দুই সিটি করপোরেশনের। নির্ধারিত কাজ শেষ হলে জলাবদ্ধতা থেকে রাজধানীবাসীকে বহুলাংশে রক্ষা করা যাবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের।
খালগুলোর দায়িত্ব পাওয়ার পর কেন জলাবদ্ধতা কমছে না এ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর ২ জানুয়ারি থেকে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগরসহ খালগুলোর শাখা-প্রশাখা এবং পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট থেকে আমরা বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু করেছি। ইতোমধ্যে এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১ লাখ ৩৫০০ টনের বেশি বর্জ্য ও ৬ লাখ ৭৯ হাজার টন পলি অপসারণ করেছি।
এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া অচল দুটি পাম্প স্টেশনের তিনটি পাম্প মেশিন সচল করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি তিনটি সচল করতে জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে পাওয়া বন্ধ নর্দমা ও আমাদের উন্মুক্ত নর্দমাগুলো পরিষ্কারের কাজ চলমান। চলতি মাসের মধ্যেই তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। কাজগুলো শেষ হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে যাবে। আগামী ২ বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতাকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনতে সক্ষম হবো।
এদিকে গত (২ জুন ) এক অনুষ্ঠানে জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে মেয়র তাপস বলেছিলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে আগামী দুই মাস আমাদের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী মাঠে থাকবেন। যেখানেই জলাবদ্ধতা দেখা দেবে সেখানেই দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে ডিএসসিসি তার নিজস্ব অর্থায়নে ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প হাতে নিয়েছি। আমাদের লক্ষ্য সাধারণ বৃষ্টিপাত হলে যাতে ঢাকা শহরে পানি না জমে সে কাজ দ্রুত সম্পন্ন করা। এছাড়া ভারী বৃষ্টি হলে যেন তিন ঘণ্টার মধ্যে সব পানি নেমে যেতে পারে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি আমরা।
অন্যদিকে দায়িত্ব নেওয়ায় পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতায় থাকা খাল থেকে ১১ হাজার ৬৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। খালের তলদেশ থেকে অপসারণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৮০০ টন কঠিন বর্জ্য। বর্তমানে খালগুলোয় পানি প্রবাহ সচল রয়েছে। পানি প্রবাহ আরও বৃদ্ধির জন্য কাজ চলমান রয়েছে। মোট ২১ হাজার ৮৪৩ জন পরিচ্ছন্নতাকর্মী খাল পরিষ্কারে কাজ করছেন। পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসা থেকে পাওয়া ১৮০ কিলোমিটার স্ট্রর্ম স্যুয়ারেজ ড্রেনের মধ্যে ৯৪.৭১ কিলোমিটার ড্রেন পরিষ্কারের জন্য ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচটি আঞ্চলিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসি এলাকায় জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে মগবাজার, মধুবাগ, কারওয়ান বাজার, উত্তরা ১ নম্বর সেক্টরসহ এয়ারপোর্ট রোড এবং বনানী রেলগেট থেকে কাকলী মোড় পর্যন্ত ড্রেন নির্মাণ ও পাইপলাইন স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া ইব্রাহিমপুর খাল, কল্যাণপুর খাল, আব্দুল্লাহপুর খিজির খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা হয়েছে।
শনিবার (৫ জুন) এক অনুষ্ঠানে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম জলাবদ্ধতার বিষয়ে বলেন, নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাজ করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ডিএনসিসি বিভিন্ন জায়গায় খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। জনগণের সহায়তায় তা অব্যাহত থাকবে। গত ১ জুন ঢাকায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নগরবাসীকে জলজট থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা কাজ করে যাচ্ছি নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সরকারী সেবাসংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়।এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শাহ আলম খান বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নই, জলাশয় ভরাট ও অবৈধ দখলদারিত্বই জলাবদ্ধতার বড় কারণ।
পানি নিষ্কাশনের দুটি পথ আছে৷ এক. ভূ-গর্ভে পানি শোষণ করে নেয়া এবং দুই. খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যাওয়া৷ ঢাকায় এই দুটি পথের একটিও কার্যকর নেই৷ এ কারণে জলাবদ্ধতা বাড়ছেই৷ এ থেকে উত্তরনে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ও থাকতে হবে।
এসডব্লিউ/এমএন/ এফএ/১৯২০
State watch সকল পাঠকদের জন্য উন্মুক্ত সংবাদ মাধ্যম, যেটি পাঠকদের অর্থায়নে পরিচালিত হয়। যে কোন পরিমাণের সহযোগিতা, সেটি ছোট বা বড় হোক, আপনাদের প্রতিটি সহযোগিতা আমাদের নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বড় অবদান রাখতে পারে। তাই State watch-কে সহযোগিতার অনুরোধ জানাচ্ছি। [wpedon id=”374″ align=”center”]
আপনার মতামত জানানঃ